খুলনা: আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের আমি বিচার চাই। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের আমি ফাঁসি চাই।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সেলিম হোসেনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন।
শনিবার (৪ নভেম্বর) সকালে রিক্তা বলেন, আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের বাইরেও কোথাও যেতেন না। সে অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিল। অথচ তাকে অকালে এভাবে চলে যেতে হলো। এখন আমি একমাত্র সাড়ে ৬ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস অনিকাকে নিয়ে কোথায় যাবো? অনেকে বলছে, মামলা করলে আপনাদের উপর হুমকি আসবে। তারপরও আমি বাদী হয়ে মামলা করবো। অবুঝ মেয়ে ৫ মিনিট পর পর বলছে মা আমি মারা যাব। আমার বাবা কই? তাকে কোনভাবে সামলাতে পারছি না।
মৃত্যুর দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কুয়েটের প্রধান গেট সংলগ্ন ৬ তলা রোজ লাইন বিল্ডিংয়ের দোতলায় নিজস্ব ফ্যাটে আমার বসবাস করছিলাম। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় বললো আড়াইটায় ল্যাব আছে। দেড়টা বেজে গেলেও আসেনি দেখে আমি টেনশন করছিলাম। ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বাসায় এসে বললো দেরি হয়ে গেছে। স্টুডেন্টরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমি বিকেলে দায়িত্ব ছেড়ে দেব। তখন তার দিকে তাকিয়ে দেখি বিমর্ষ চেহারা। এরপর গোসল করতে যায়। মেয়ে বার বার বাথরুমের দরজা ধাক্কা দেয় কিন্তু অন্য দিনের মতো ওর বাবা কোনো কথা বলে না। এরপর আমি ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকি কোনো সাড়া দেয় না। আমি ভয় পেয়ে পাশের বাসার লোকদের ডেকে এনে দরজা ভেঙে দেখি টয়লেটের ওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছে। মুখে পানি দেওয়ার পর হুশ এলো । সবাই হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমাকে সাথে নিল না। কিছুক্ষণ পর ফোন করে বলল ভাবি আপনি শক্ত হন। ভাইকে চুয়াডাঙ্গায় না কুষ্টিয়ায় নেওয়া হবে?
শিক্ষকের স্ত্রী রিক্তা বলেন, মৃত্যুর আগের দিন কি তার আগের দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমরা এক সঙ্গে বসেছিলাম। একটি ফোনে কথা বলার পর দেখি তার মন খারাপ। বললো হলের কে যেন ফোন দিয়েছে। এরপর আবারও ফোন আসে। ফোনে কে যেন বলে আমাদের গ্রুপের মধ্যে কাউকে দায়িত্ব দিয়েন। তখন সে বলল- অনেকে তো আবেদন করেছে। দেখি কি করা যায়। ফোন কাটার পর আমি বলি কি হয়েছে? সে বলে তুমি এসব বুঝবে না। তখন আমি বলি- আমি ভিসি স্যারের কাছে যাবো তাকে বলবো আমার ছোট বাচ্চা আছে। আপনারা যখন তখন তাকে ডাকলে আমি বাচ্চা নিয়ে কীভাবে একা বাসায় থাকবো। এ কথা শুনে আমার স্বামী বলে তোমার যাওয়া লাগবে না আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেব।
তিনি বলেন, ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছি। ২০১১ সালে পাশ করেছি। কিন্তু আমার স্বামী বলতো তোমার চাকরি করার প্রয়োজন নেই। আমি যা আয় করবো তা দিয়ে আমাদের হয়ে যাবে। তুমি মেয়েকে মানুষ করো। আমার স্বামীর ক্ষতিপূরণ কি এক কোটি টাকা দিয়ে হবে। মাত্র ১২ বছর সে চাকরি করেছে। বাকি জীবনে সে কোটি কোটি টাকা আয় করতো। তার আরও প্রমোশন হত। সে পর্যায়ক্রমে ডিন হয়ে যেতো।
স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রিক্তা বলেন, সে সব সময় হাসি খুশি থাকতো। কাউকে কিছু বলতো না। মেয়েকে বকলে তাকে বলতো তোমার মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চল পাবনায় দিয়ে আসি। মেয়ে আর আমি ছিলাম তার জান। কোথাও যদি আমাদের রেখে যেত তাহলে পাশের বাসার ভাই ভাবিদের ফোন করে বার বার খোঁজ নিতে বলতো।
মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) বেলা ৩টায় মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেন (৩৮)। সম্প্রতি কুয়েটের লালনশাহ হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য-ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে ফজলুল হক হলের বর্ডার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান তার অনুগতদের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচিত করার জন্য ড. সেলিমকে চাপ দেন। ঘটনার দিন দাপ্তরিক কক্ষে অশালীন আচরণ ও মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হন তিনি। ৩০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্ররা ক্যাম্পাসের রাস্তা থেকে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা শুরু করেন। পরে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধা ঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পরে শিক্ষক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের জন্য ক্যাম্পাসের কাছে বাসায় যাওয়ার পর ২টায় তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে কিছু সাধারণ ছাত্রের জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনে তার মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে অপমৃত্যুর অভিযোগ এনে ড. মো. সেলিমের কফিনসহ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের কাছে বিচার চান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মামলার জোর দাবি জানান।
প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় ওই দিন রাতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ কমিটির সভাপতি ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম। এছাড়া দুইজন সদস্য হলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান ও ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. কল্যাণ কুমার হালদার। তবে এদের মধ্যে থেকে অধ্যাপক ড. কল্যাণ কুমার হালদার লিখিত ভাবে ও ড. মো. আরিফুল ইসলাম অলিখিত ভাবে তদন্ত করতে অপারগতা জানিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমটিরি এই দুই সদস্য ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ চালাতে বিব্রত বোধ করছেন। সেলিমের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে শুক্রবার রাতে পাঁচ সদস্যের নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে দোষীদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ ৫ দফা দাবিতে বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে শিক্ষক সমিতি। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান শিক্ষকরা।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কুয়েটের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাজী সাজ্জাদ হোসেনসহ সিন্ডিকেট সদস্যরা অংশ নেন।
ড. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তাল হওয়ায় এ জরুরি সিন্ডিকেট সভার ডাক দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে সিন্ডিকেট সভায় ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধসহ বিকেল ৪টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার পর ৭টি আবাসিক হলে থাকা প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী হল ছাড়েন।
*** কুয়েটে শিক্ষকের মৃত্যু, ফের তদন্ত কমিটি গঠন
*** হল ছেড়েছেন কুয়েট শিক্ষার্থীরা
*** কুয়েট শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় খুবি শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ
*** কুয়েট বন্ধ ঘোষণা, হল ত্যাগের নির্দেশ
*** কুয়েটে শিক্ষক সেলিমের মৃত্যু, প্রতিবাদ সমাবেশ
*** ছাত্রলীগ নেতার চাপে শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ, উত্তপ্ত কুয়েট
বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২১
এমআরএম/কেএআর