ফেনী: ফেনী সরকারী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের আনার্সের (স্নাতক) শিক্ষার্থী রেজাউল কাদের জিহাদ। ২০১৯ সালে তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হয় সে।
এদিকে ২১ সালে স্কুল-কলেজ খুললেও কোনো পরিক্ষা নেওয়া হয়নি। ২২ সালে পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করা হলেও করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে আবারও সেটা পেছানো হয়েছে। যেখানে ২০২২ সালে এই শিক্ষার্থীর অনার্স শেষ করার কথা থাকলেও সেখানে এখনও তৃতীয়বর্ষে আটকে আছে সে। কত সালে আনার্স শেষ হয় তা নিয়ে রয়েছে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। চার বছরের অনার্স শেষ করতে কত বছর লাগে তা বলাও মুশকিল।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জুনাইদ আল হাবিব। ২০১৯-২০ সেশনের অনার্সের শিক্ষার্থী সে। ২০২১ সালের শেষ দিক প্রথম বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া হয় তাদের, এখনও আসেনি ফলাফল। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাশ শুরু হলেও একদিন মাত্র সশরীরে ক্লাশ করার সুযোগ হয়েছে। তৃতীয় বর্ষে থাকার কথা থাকলেও ঠিকমত শুরু হয়নি দ্বিতীয়বর্ষ, ফলাফল মেলেনি প্রথমবর্ষের।
এমন এক-দুই জন নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভোগান্তির গল্প প্রায় একই। সেশনজটে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন এসব শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে পড়াশুনা শেষ না হওয়ায় চাকরির জন্যও চেষ্টা করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার সেশনজটে পড়ে সরকারী চাকরিতে আবেদন করার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে সবকিছু নিয়ে বাড়ছে হতাশা আর দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের মাথায়। অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছিটকে পড়ছে শিক্ষা জীবন থেকে। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই আন্দোলনে নেমেছেন- তাদের পরীক্ষা যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে নেওয়া হয়।
দুই বছর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর গেল বছর নভেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এরপর অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও ডিগ্রি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হলেও বিগত ২১ জানুয়ারি থেকে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিলে ফের সব পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
যদিও গত মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) স্থগিত হওয়া সব পরীক্ষার নতুন সূচি প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়াতে অন্যান্য বর্ষের পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে সেশনজট কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর এতেই দীর্ঘ ২ বছর ধরে একই বর্ষে অধ্যয়নরত রয়ে গেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শিক্ষার্থীরা। যেখানে অন্যান্য প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে, সেদিকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
নাম মাত্র অনলাইন ক্লাস হলেও পরীক্ষার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ক্লাস কিংবা কোন পরীক্ষা ছাড়াই অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীদের শর্ত সাপেক্ষে অটো প্রমোশন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন জানানো হয় করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে এলে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু মহামারি করোনা অব্যাহত থাকায় পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় সেশনজটের কবলে পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সব কলেজের স্নাতক (সম্মান) ও ডিগ্রী (পাশ) কোর্সের শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর নভেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এরপর অনার্স চতুর্থ বর্ষ ও ডিগ্রি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হলেও বিগত ২১ জানুয়ারি থেকে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিলে ফের সব পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যার ফলে আগামী ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও স্থগিত হয়ে যায়। যদিও গতকাল স্থগিত হওয়া সব পরীক্ষার নতুন সূচি প্রকাশ করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এক বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়াতে অন্যান্য বর্ষের পরীক্ষা ও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে সেশন জট কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
আসিফ হায়দার নামের নোয়াখালী সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রথম বর্ষের পরীক্ষা হয়েছে শুধু। অন্যান্য শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চতুর্থবর্ষের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়াতে অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীরা চিন্তিত আছে তাদের কখন পরীক্ষা হবে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে অনার্স শেষ করার কথা কিন্তু ২০২২ সাল চলছে এখনও ফাইনাল পরীক্ষা হয়নি। কবে নাগাদ শেষ করতে পারব তা জানি না।
রায়হান নামের ফেনী কলেজের আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অপরাধ করেছি কিনা জানি না। অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারিনি এখনও, কবে নাগাদ পরীক্ষা হবে, কবে আমরা চাকরির জন্য আবেদন করতে পারব এ নিয়ে চিন্তায় আছি।
তিনি বলেন, সরকারি চাকরির একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকে। আমরা যথা সময়ে অনার্স শেষ করতে না পারলে সে সময়ে কিভাবে চাকরির জন্য আবেদন করবো সেটা ভাবছি। পরীক্ষার জন্য সব ধরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কিন্তু করোনার জন্য ফের বন্ধ হওয়াতে আমরা আমাদের জীবনের অগ্রগতি নিয়ে সংশয়ে আছি।
শিক্ষার্থীদের হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফেনী সরকারি কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল বলেন, মহামারি করোনা ভাইরাসে সারা বিশ্বেই এর প্রভাব পড়েছে৷ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। করোনার প্রকোপ কাটিয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব পরীক্ষা নিতে আন্তরিক বলে জানান তিনি।
অধ্যক্ষ বলেন, সেশনজট কাটিয়ে উঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করছে।
অনলাইন ও এসাইন্টমেন্টের মাধ্যমে সাময়িক পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। করোনা মহামারী না আসলে এই জট হতো না। আগে অনার্স শেষ করতে ৬ থেকে ৭ বছর সময় লাগত কিন্তু এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের মতো সেই জট নেই। সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে দ্রুত সব পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের হতাশ না হয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, এটি দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়। সারা দেশের অনেক কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। তাই সব কিছু সম্ভব হয়ে উঠেনি৷ পরীক্ষা শুরু হয়েছিল কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে সাময়িক স্থগিত হয়েছিল। নতুন সূচি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে প্রকাশিত সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২২
এসএইচডি/এনএইচআর