সিলেট: বৃষ্টির বাগড়া, কেন্দ্রে প্রার্থীর সমর্থকদের হট্টগোল। এ দুই ইস্যুতে উৎকণ্ঠা থাকলেও অবশেষে কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষ হলো সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ।
বুধবার (২১ জুন) সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলে। ভোট চলাকালে কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতার কারণে ভোটে ব্যাঘাত ঘটেনি।
তাছাড়া এ কয়দিন সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। যে কারণে ভোটের দিন বৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, এমনটি ধারণা ছিল নির্বাচনী কর্মকর্তা, প্রার্থী, সমর্থক, ভোটারদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিহীন থেকে বুধবার (২১ জুন) সিলেটের আকাশ। ভোটাররা রোদ্রজ্জল পরিবেশে নিজেদের ভোট প্রয়োগ করতে পেরেছেন।
বিকেল ৪টায় ভোট গ্রহণ শেষ হলেও কোথাও কোনো গোলমালের খবর পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকালে সিলেরটর বিভাগীয় কমিশনার মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমি বেশকিছু কেন্দ্র ঘুরেছি। মানুষের মধ্যে খুবই স্বতস্ফূর্ততা লক্ষ্য করেছি। কেবল বৃষ্টি নিয়ে আতঙ্কিত ছিলাম। ভোটের সুন্দর পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারতো। আল্লাহর রহমত, বৃষ্টি হয়নি।
তিনি বলেন, অল্পসংখ্যক লোকেরই আঙুলের ছাপ আসেনি। যদিও নির্বাচন কর্মকর্তারা পরবর্তীতে সেটি সমাধান করে দিয়েছেন। আর ইভিএম মেশিনে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। এরপরও প্রতি তিনটি কেন্দ্রে একটি টেকনিক্যাল টিম ছিল।
ইভিএমে ধীর গতি: দীর্ঘক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নারী ভোটাররা। ভোটগ্রহণে মন্থর গতির কথা স্বীকার করে নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ করে নারী ভোটারদের অনেকে ইভিএমে অভ্যস্ত না হওয়ায় ভোটগ্রহণে দেরি হচ্ছে।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্রী পারমিতা দেব প্রিমা। তিনি বলেন, জীবনের প্রথম ভোট দিতে ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে হাজির হই সকাল ১০টায়। তবে কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথের সামনে আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তারা ভোট দিতে পারিনি।
বিরক্তি প্রকাশ করে প্রিমা বলেন, চার বান্ধবী এক সঙ্গে এসেছিলাম। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে। চারঘণ্টায়ও লাইন খুব একটা এগোয়নি। এ কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথের সামনে নারীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আলা উদ্দিন বলেন, মেশিনে সমস্যা নেই। তবে একজনের ভোট দিতে ১০ মিনিট লাগে। ভোটারদের ইভিএম পদ্ধতি বুঝতে সময় লাগছে। তিনি জানান, কেন্দ্রে মোট ২৯৪০ ভেটার। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬৮৬ কাস্টিং হয়েছে।
নগরের শাহজালাল উপশহর প্রাথমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং অফিসার কাজী মেহেদী কামাল মিম বলেন, বেলা পৌনে ১টা পর্যন্ত ২০৮৭ ভোটের মধ্যে ১৬ শতাংশ অর্থাৎ ৩২৬ ভোট কাস্ট হয়েছিল।
৩৬ নং ওয়ার্ডের প্রিসাইডিং অফিসার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, কেন্দ্রে নারী ভোটাররা ভোট দিতে বেশ সময় নেন। তারা এতটা অভ্যস্ত না। আর নারী ভোটারের তুলনায় পুরুষের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। বেলা ২টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ৩ হাজার ৮০০ ভোটের মধ্যে ১৩০০ অর্থাৎ ৩২ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে।
একই রকমের তথ্য জানিয়ে নগরের শাহপরান এলাকার কৃষ্ণ গোবিন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সুচয়ন দাশ বলেন, ইভিএমে ভোটাররা অভ্যস্ত না। তাই দেরি হচ্ছে। বিশেষত বয়ষ্ক একেকজনের ভোটপ্রদানে ১০ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগছে। এতে আমরাও বিরক্ত। দুপুর ১টায় তিনি বলেন, এখানে ২৪৪৫ ভোটারের মধ্যে ৮০০ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ওই সময়ে সিলেটে গড়ে ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানা গেছে।
ভোটের মাঠে ছিল নারীদের আধিক্য: কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষ ভোটাদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারীদের আধিক্য ছিল বেশি। দীর্ঘলাইনে অপেক্ষায় থেকেও নারীরা ভোট দিয়েছেন।
বাবুলের অভিযোগ: সকাল ৯টায় সিলেট সিটি করপোরেশনের ৯ নং ওয়ার্ডের আনন্দ নিকেতন কেন্দ্রে ভোট প্রদান শেষে জাপার মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমি ভোট দিতে এসে দেখি আন্দোলন নিকেতন কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে পেশি শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কেন্দ্রের ভেতরে এজেন্ট ও ভোটারদেরকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। আমার কাছে ফোন এসেছে আমার এজেন্টের কেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছে না ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। এভাবে যদি চলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। কারণ জনগণ লাঙলকে ভোট দিতে চায়। মানুষ যাতে লাঙলকে ভোট না দেয় সেজন্য তারা হয়রানি করছে।
এজেন্ট নেই লাঙলের প্রার্থীর: নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে অধিকাংশ কেন্দ্রে লাঙলের প্রার্থীর এজেন্ট খোঁজে পাওয়া যায়নি। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাঙলের প্রার্থী কোনো এজেন্ট দেননি।
অথচ আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে বাবুলের এই অভিযোগের ব্যাখায় নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান জানিয়েছিলেন। তিনি সব কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারছেন না। তাই নির্বাচনের দিনতো কিছু না কিছু বলতে হবে। সেটিই বলেছেন।
আশাবাদী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী: বুধবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে সিটি করপোরেশনের ৮ নং ওয়ার্ডের পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা কেন্দ্রে সস্ত্রীক ভোট প্রদান করেন নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
ভোট প্রদান শেষে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, উৎসবমুখর ভোট প্রদানের পরিবেশ উৎসবমুখর। ভোটের পরিবেশ ভালো। ইনশাআল্লাহ জয় হবে। ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, তিনি মেনে নেবেন তিনি। আর জিতলেও পরাজিত প্রার্থীর বাড়িতে যাবেন এবং হারলে অপরাজিত প্রার্থীর বাড়িতে যাবেন।
পঞ্চমবারের মতো ভোট উৎসবমুখর পরিবেশে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে বুধবার (২১ জুন) সকাল ৮টা থেকে ১৯০ কেন্দ্রে একযোগে ভোট গ্রহণ শুরু হয়।
মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ জন প্রার্থী। তারা হলেন, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় পার্টির মো. নজরুল ইসলাম (বাবুল), জাকের পার্টির প্রার্থী মো. জহিরুল আলম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা, মো. শাহ জাহান মিয়া, মো. ছালাহ উদ্দিন এবং মো. আবদুল হানিফ।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মাহমুদুল হাসান ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৮৭ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৭২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২ টি ওয়ার্ডে ১৯০টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৬৪টি কক্ষে ভোট দেবেন ৪২টি ওয়ার্ডের ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন ভোটার। এসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে রয়েছেন ১৯০ জন প্রিসাইডিং অফিসার, ১ হাজার ৩৬৭ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং ২ হাজার ৭৩৪ জন পুলিং অফিসার। কেন্দ্রগুলোতে স্থাপিত ১ হাজার ৭৪২টি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ২ হজার ৬০০ পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটেএবং ৪২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৭ জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জুন ২০২৩
এনইউ/জেএইচ