প্রবাসীদের ভোটার করে নেওয়াকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বিদেশ ট্যুরের ধুম লেগেছে। মূলত ভোটার কার্যক্রম তদারকি করতে যাচ্ছেন কমিশনাররা।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা একেক দেশ সফর করছেন। সে তালিকায় রয়েছেন ইসি সচিব আখতার আহমেদও।
সিইসি বর্তমানে রয়েছেন কানাডায়। ১০ দিনের সফরে দেশটিতে তিনি ভোটার কার্যক্রম দেখতে, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিতরণ উদ্বোধনের কাজে গেছেন।
এর আগে গত এপ্রিলে কানাডায় একই কাজে গেছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ। তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম কানাডার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রও সফর করে এসেছেন। উদ্দেশ্য ছিল দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ ছাড়া আমেরিকায় গিয়েছিলেন মতবিনিময় করতে। অতিরিক্ত সচিবের ওই সফর ছিল ১৩ দিনের।
এপ্রিলেই কানাডায় ১১ সদস্যের দুটি টেকনিক্যাল টিমও সফর করেছে ১৭ দিন। একই মাসে ১৮ দিনের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে কর্মকর্তাদের ১১ সদস্যের দুটি টিম সফর করেছে। একই সময়ে ছয় সদস্যে একটি টিম সফর করেছে যুক্তরাজ্যে।
এপ্রিলেই এনআইডি মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম সাত দিন অস্ট্রেলিয়া ও দুদিনের জন্য সিঙ্গাপুর সফর করেছে।
একই কাজে ইসি সচিব আখতার আহমেদ আগস্টে পাঁচ দিনের সফর করেছেন জাপানে। এ ছাড়া একটি পাঁচ সদস্যের টেকনিক্যাল টিম দেশটিতে সাত দিন সফর করেছে একই মাসে।
চলতি মাসেই ইসি সচিব ও এনআইডি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে চার সদস্যে দুটি টিম যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন ১০ দিনের জন্য। তারা প্রশাসনিক টিম হিসেবে যাবেন। দেশটিতে চারটি টেকনিক্যাল টিমেও যাবেন ১৬ জন।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার অবস্থান করছেন মালয়েশিয়ায়। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ অক্টোবরে যাচ্ছে সুইডেনে। এই নির্বাচন কমিশনার মধ্যপ্রাচ্যে এর আগে একাধিকবার একই কাজে সফর করেছেন। নির্বাচন কমিশনার তাহমিদ আহমদ অক্টোবরে একটি সম্মেলনে যাচ্ছে মরোক্কোয়।
আগামী মাসে অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ জর্ডান যাচ্ছেন প্রশাসনিক টিম নিয়ে। দেশটিতে চার সদস্যের একটি টেকনিক্যাল টিমও যাচ্ছে। যুগ্ম সচিব আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে প্রশাসনিক টিম যাচ্ছে মালদ্বীপে, এনআইডি প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক নুরুজ্জামান খান প্রশাসনিক টিম নিয়ে যাচ্ছেন ওমানে। প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী প্রশাসনিক টিম নিয়ে যাচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকা।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভোটার কার্যক্রম সংক্রান্ত মতবিনিময়, ভোটার নিবন্ধন উদ্বোধন, এনআইডি বিতরণ ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামেই চলছে এই সফরের ধুম। যদিও কোনো কোনো দেশে একই কাজ আগের দুই কমিশনের সময়েও করা হয়েছে। বিগত কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন ও কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়েও একই দেশে একই কাজে এমন সফর হয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, দুবাই, কানাডা, ইতালিতে একাধিকবার সফর হয়েছে।
প্রবাসী ভোটারের এই কার্যক্রমের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে আইডিইএ (স্মার্টকার্ড) প্রকল্প-২ থেকে। আগে এমন ট্যুরের ব্যয় বহন করা হতো আইডিইএ প্রকল্প-১ থেকে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড সরবরাহ করতে পারছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, সেখানে এই ব্যয় অপচয় ও বিড়ম্বনা ছাড়া কিছু নয়।
অন্যদিকে সামনে জাতীয় নির্বাচন। বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে নীতিনির্ধারকদের এই ট্যুরের প্রভাব পড়ছে ভোটের প্রস্তুতিতেও। সিইসি বাইরে থাকায় দল নিবন্ধন ও সংলাপের বিষয়টি চূড়ান্ত হচ্ছে না।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, সিইসি দেশে ফিরলেই দল নিবন্ধনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। বর্তমানে মাঠ পর্যায় থেকে আসা তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা চলছে।
ভোটের সামনে লাগাতার শীর্ষ কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনারদের বিদেশ সফর নিয়ে দায়িত্বশীলদের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বর্তমানের ১০টি দেশের ১৭টি স্টেশনে দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটার কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংস্থাটি। দেশগুলো হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান। শিগগিরই আমেরিকার পাশাপাশি আরো অন্তত চারটি দেশে শুরু হতে পারে এ ভোটার নিবন্ধনের এই কাজ।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর সে লক্ষ্য নিয়েই প্রবাসে ভোটার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। ভোটার কার্যক্রমের মাধ্যমেই প্রবাসীদের এনআইডি সরবরাহ করছে সংস্থাটি। এজন্য দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মাধ্যমে নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করছে। ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, প্রবাসীদের ভোটার করে নিয়ে ভোটাধিকার নিশ্চিতে তার কমিশন অন্তত শুরুটা করতে চান। সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে চান।
প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটার নিবন্ধন ও এনআইডি বিতরণের কাজটি করছে ইসি। এক্ষেত্রে ইসি কর্মকর্তারা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আর তারা একটি নির্দিষ্ট ফি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দিচ্ছেন। এরপর তদন্ত শেষে অনুমোদন দিচ্ছে কমিশন।
বিদেশে বসে ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে পূরণকৃত আবেদনপত্র (ফরম-২(ক), মেয়াদ সম্বলিত বাংলাদেশি পাসপোর্ট/মেয়াদহীন পাসপোর্ট/এনআইডিধারী তিন নাগরিকের প্রত্যায়ন, অনলাইন জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি বাধ্যতামূলকভাবে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন কেন্দ্রে (দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট ডেস্কে) জমা দিতে হয়।
এদিকে বিশেষ ৫৬টি উপজেলা/থানার (চট্টগ্রাম অঞ্চল) নাগরিকদের জন্য ‘বিশেষ তথ্য ফরম’ পূরণ, শিক্ষা সনদ, বাবা-মার এনআইডি, মৃত হলে মৃত্যু সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স/টিআইএন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), কতিপয় দেশের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নিকাহনামা এবং স্বামী-স্ত্রীর এনআইডি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাগরিকত্ব সনদ (কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান/মেয়র/সিইও কর্তৃক), ইউটিলিটি বিলের কপি (ভোটার এলাকার ঠিকানার বিদ্যুৎ/পানি/গ্যাস বিলের কপি, ভাড়াটিয়া হলে বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র ও বাড়িওয়ালার অনাপত্তিপত্র জমা দিতে হবে।
বাধ্যতামূলক নয়, এমন তথ্যগুলো নিবন্ধন কেন্দ্রে জমা দিতে না পারলে প্রবাসী নাগরিকরা দেশে বসবাসকারী তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পারবেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পেয়ে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৯ সালে প্রবাসে ভোটার কার্ক্রম বা এনআইডি সরবরাহের উদ্যোগটি হাতে নেয়। এরপর ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অনলাইনে ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করে ইসি। এর আগে ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীদের মধ্যে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। তার আগে একই বছরের ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অংশ হিসেবে অনলাইনে আবেদন নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরপর সৌদি আবর, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে থাকা বাংলাদেশিদের জন্যও এ সুযোগ চালু করা হয়। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে থমকে যায় দূতাবাসের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা। পরে ২০২২ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই কার্যক্রমকে ফের উজ্জীবিত করেন। এক্ষেত্রে আগের আবেদনগুলো পাশ কাটিয়ে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করেন তারা। সেই কার্যক্রমকেই এগিয়ে নিচ্ছে বর্তমান নাসির কমিশন।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১০টি দেশ থেকে আবেদন এসেছে ৫৫ হাজারের মতো। এদের মধ্যে দশ আঙুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩০ হাজারের বেশি প্রবাসী।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সি-বায়রাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে। এসব দেশকেই মাথায় রেখে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দেশগুলো হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মৌরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এসব দেশে এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে রয়েছে বেশি প্রবাসী রয়েছে সৌদি আরবে, ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জন। আর সবচেয়ে কম রয়েছে নিউজিল্যান্ডে দুই হাজার ৫০০ জন। এসব দেশেই ভোটার কার্যক্রম, এনআইডি কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে শুরু করবে কমিশন।
ইসির এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এএসএম হুমায়ুন কবীর এ বিষয়ে বলেন, আগামী মাসেই আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্যক্রম শুরু করতে পারবো বলে আশা করি। এ ছাড়া ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান ও মালদ্বীপে কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা চলছে। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সম্মতি পাওয়া গেছে।
ইইউডি/আরবি