ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

সংক্ষরণের ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকায় চুরি-নষ্ট হচ্ছে ইভিএম

ইকরাম-উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২২
সংক্ষরণের ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকায় চুরি-নষ্ট হচ্ছে ইভিএম

ঢাকা: সংরক্ষণের ন্যূনতম ব্যবস্থা না থাকায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চুরি যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে নষ্টও হচ্ছে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছ থেকে কেনা প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা দামের প্রতিটি মেশিন মাঠ পর্যায়ে পড়ে রয়েছে অযত্ন আর অবেহলায়। কোথাও বাসা-বাড়ি, কোথাও গোডাউন, কোথাও স্কুল-কলেজে রাখার ফলে এগুলো যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি চুরিও যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১০০টির বেশি মেশনি চুরি ও নষ্ট হয়েছে। ফলে ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি টাকার বেশি।

ইভিএম প্রকল্পটি নেওয়ার সময় এ মেশিন রাখার ব্যবস্থার কথা ভাবেনি কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে তড়িঘড়ি করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৮০ হাজার মেশিন ও পরে ৭০ হাজার মেশিন ক্রয় করে ওই কমিশন। এরপর বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা হলে দীর্ঘদিন ভোটকেন্দ্রেই রাখা হয়। কিছু মেশিন উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে ও বিভিন্ন গোডাউনে রাখা হয়। ফলে ইভিএম রাখার জন্য যে নিরাপত্তাগুলো রাখা দরকার, তা মানা হয়নি।

কর্মকর্তারা বলছেন, ইভিএম মেশিন নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আদ্রতায় রাখতে হয়। এছাড়া ব্যাটারি চার্জ করতে হয় মাঝে মধ্যে। অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা দরকার। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, কিছু ইভিএম আমাদের নষ্ট হয়েছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে। ওখানে কিছু ইভিএম রাখা হয়েছিল যে গোডাউনে, সেই গোডাইনে আগুন লেগে যায়। আগুন নেভাতে গিয়ে যে ব্যবস্থায় ফায়ার ব্রিগেড পানি দেয়, পানি দেওয়ার ফলে ইভিএম নষ্ট হয়। সেখানে ২০০ ইভিএম রাখা হয়েছিল, বেশ কিছুই নষ্ট হয়।

এছাড়া ব্রাহ্মবাড়িয়ার কসবায় চুরির ঘটনা ঘটে। উপজেলা পরিষদের অডিটরিয়াম আছে, সেই অডিটরিয়ামে স্টোর করে রাখা ছিল, সেখানে কিছু মনিটর চুরি হয়। কসবাতে চুরি যায়, আর ঝিনাইদহে বয়েজ স্কুলে রাখা ছিল, সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই ছিল। বইয়ের সঙ্গে মনিটরও চুরি হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ প্লাস হবে আরকি।

সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তা এ বিষয়ে মামলা করেছেন। সংশ্লিষ্ট থানাকেও মেশিন খুঁজে বের করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, চুরির প্রধান কারণ যেটা সেটা হচ্ছে ইভিএমের জন্য যে ওয়্যারহাউজ বা স্টোরেজ দরকার, সেটা না করে বিভিন্ন জায়গায় যেখানে এভেলেবল পাচ্ছে, সেখানে রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রোপার যে সিকিউরিটি বোঝায়, সে ধরণের সিকিউরিটি কোথাও নাই। যার জন্য এ ঘটনা ঘটছে। ৫০ থেকে ৭০টি নষ্ট হয়েছে বৃষ্টিতে।

এ কর্মকর্তা বলেন, মাঠ পর্যায়ে ৯৩ হাজার মেশিন বিভিন্ন জায়গায় আছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার মেশিনের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ২ হাজার ৫০০টি করে থাকবে। তারপর যেখানে প্রয়োজন হয় নির্বাচনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

ইভিএম প্রোপার জায়গায় থাকতে হবে। বিএমটিএফ যে স্ট্যান্ডার্ডে পাঁচ বছর ধরে রাখছে, সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি।  ওখানে অপটিমাম কন্ডিশনে যেভাবে রাখে, চার্জ দিয়ে অন্যান্য সিকিউরিটি ব্যবস্থা যা আছে, ফায়ার হ্যাজার্ড এবং অন্যান্য হ্যাজার্ডের যে প্রিকোশন নিয়ে রাখে, মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেন করে নিদেন পক্ষে ১০টা রিজিয়নে যদি সেভাবে স্টোরেজ বা ওয়্যারহাউজ বানানো যায়, তাহলে একমাত্র সম্ভব। এছাড়া অন্যান্যভাবে এটাকে আসলে এ সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা দিয়ে রাখা বা বাসা-বাড়িতে রাখলে তেমন একটা সুবিধা হবে না। কমিশন এটা নিয়ে কনসার্ন, জানানো হয়েছে। সাধ্যমত চেষ্টা করা হচ্ছে যেভাবে রাখা যায়। ৩০টি জেলায় বাসা-বাড়িতে রাখা হচ্ছে। এতে ঝুঁকি তো কিছু থাকছেই। কম্প্রমাইজ ওয়েতেই রাখা হচ্ছে।

বর্তমানে যে সংখ্যক মেশিন আছে তা দিয়ে কতটি আসনে নির্বাচন করা যাবে- তার জবাবে তিনি বলেন, ইভিএম যা আছে তাতে ৭০-৮০টা আসনে হয়তো পারব। আরও ইভিএম কেনা হবে কি-না, সেটা কমিশনের সিদ্ধান্ত। কমিশন সিদ্ধান্ত দিলেই বলা সম্ভব।

২০১০ সালে এটিএম শামসুল ‍হুদার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কমিশন দেশে ভোট ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে ইভিএমের সূচনা করে। সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে এ ভোটযন্ত্র তৈরি করে নেওয়া হয়েছিল।

কয়েক বছর ভালো ফল পাওয়া গেলেও ২০১৫ সালের রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের সময় একটি মেশিনে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। সেই মেশিনটি আর সারাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এমনকি ত্রুটি হওয়ার কারণও উদ্ধার করতে পারেনি।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৬ সালে এমন পরিস্থিতে বুয়েটের তৈরি মেশিনগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নষ্ট করে ফেলে। একইসঙ্গে নতুন এবং উন্নতমানে ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।

ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কেএম নূরুল হুদা কমিশন প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে অধিকতর উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেয়। নতুন ইভিএম দিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে প্রথম ভোট নিয়ে সফল হয় নির্বাচন কমিশন।

এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন (ছয়টি আসনে) ও অন্যান্য উপ-নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ মেশিন ব্যবহার করে বিগত কমিশন। বর্তমানে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনও ইভিএমের ব্যবহার বাড়াতে চায়। এক্ষেত্রে তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহারের লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু বড় পরিসরে এ মেশিন ব্যবহার করতে হলে কিনতে হবে আরও লাখের বেশি নতুন মেশিন এবং যথাযথ সংরক্ষণে রাখতে হবে হাতে থাকা ইভিএমগুলো।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২২
ইইউডি/জেডএ

*৪ হাজার কোটি টাকার ইভিএম, জায়গা নেই সংরক্ষণের
**ইভিএমের জায়গা হচ্ছে স্টোররুমে
***ইভিএম নিয়ে ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা ইসির

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।