‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’, ‘দৃষ্টি প্রদীপ জ্বেলে খুঁজেছি তোমায়’ কিংবা ‘আমার ভালোবাসার তানপুরা’- এই গানগুলো সৃষ্টি হয় ১৯৮৯ সালের দিকে। সেই থেকে তিন দশকের বেশি সময় পরও আজও শ্রোতাদের কাছে সমান জনপ্রিয়।
বাংলানিউজ: ছোট বেলায় খেলাধুলা নিয়েই থাকতেন, গানের জগতে যুক্ত হওয়া কীভাবে?
মেজবাহ রহমান: আমি গানের মানুষ ছিলাম না, হতে চেয়েছিলাম স্পোর্টসম্যান। স্বপ্ন ছিল দেশসেরা খেলোয়াড় হওয়ার। সেভাবেই খেলাধুলা করতাম, অনেক পুরস্কারও পেয়ছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ঢাকায় এলাম, এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে ক্যাম্পে থাকার সুযোগও হয়। কিন্তু বাবা আর আসতে দিলেন না। সেখানেই খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। একদিন এক বন্ধু সঙ্গে তার গিটারে ক্লাসে গেলাম। তখন গিটারে সুর আমাকে আন্দোলিত করে। এরপর স্প্যানিশ গিটারের ওপর লেসন নিলাম। এরমাঝে ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম। এরপর কলেজের অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়ে গান করতাম, দেখলাম বিপুল সাড়া। অনুষ্ঠানে একটা গানের পর সবাই বলে ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর’। এরপর খুলনার বিভিন্ন কলেজের প্রোগ্রামে আমাকে নিয়ে যেত গান গাওয়ার জন্য।
এর মাঝে ইন্টারমিডিয়েট শেষ হয় হলে খুলনাতেই অনার্সে ভর্তি হই। নব্বই দশকের শুরুর দিকে একটা ঘটনাক্রমে আমি ঢাকায় আসি, চিন্তা করলাম আমরা কিছু মৌলিক গান করি। এরপর কিছু গান রেকর্ড করে ছাড়ার পর মানুষ দেখি বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে। সেখান থেকেই শুরু হলো আমাদের গানের যাত্রা। আর শুরুতেই যেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম; বিষয়টা এমন ছিল। গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়।
বাংলানিউজ: ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ও ডিফারেন্ট টাচের শুরু কীভাবে?
মেজবাহ রহমান: ডিফারেন্ট টাচের আগে আমি খুলনার ‘রিপল ট্রাক’ ব্যান্ডে ছিলাম। যার গিটার শুনতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম উনি ওই ব্যান্ড করতেন। এই দলে তিনজন গায়ক ছিলেন। একজন রক, আরেকজন মেলডি- এভাবে ভাগ করে গাইতেন। সেই গিটারিস্টের দাওয়াতে তাদের চায়ের আড্ডায় গেলাম একদিন। আড্ডার মাঝেই তাদের সঙ্গে গান করলাম। এরপর থেকেই সেই দলে যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠান করা। একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো সমমনাদের নিয়ে একটা দল করার। সেই ভাবনা থেকে নতুন ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাওয়া। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়, তখনো ব্যান্ডের নাম ঠিক হয়নি। খুলনাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর কনসার্ট করছি। এক সময় ভাবলাম যদি অ্যালবাম করি তাহলে শ্রোতারা আমাদের গান আরও বেশি করে শুনতে পাবেন। সেই চিন্তা থেকেই ঢাকার একটি স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের কাজ শুরু করি। লক্ষ্য করলাম, আমাদের কিছু গান অন্যরা নিয়ে যাচ্ছে। তাই, দ্রুত অ্যালবাম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে, বন্ধু-শ্রোতারা সবাই বলতে লাগলেন, আমাদের গানগুলো একটু ভিন্ন ধরনের, ডিফারেন্ট। তাদের সেই ‘ডিফারেন্ট’ মন্তব্য থেকেই ব্যান্ডের নামকরণ করা হয় ‘ডিফারেন্ট টাচ’। এই নামেই আমাদের প্রথম অ্যালবাম বাজারে প্রকাশ হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
বাংলানিউজ: একটু জানতে চাই- প্রথম অ্যালবামে শ্রাবণের মেঘগুলো, ভালোবাসার তানপুরার মত গান কীভাবে পেলেন?
মেজবাহ রহমান: এগুলো কিন্তু আরেকজনের গান। আশরাফ বাবু, যার লেখা ও সুর করা এগুলো। যখন শুনলো আমরা রেকর্ডিং করব তখন কিছু গান নিয়ে এলো। দেখে মনে হয়েছে এই গানগুলো সুন্দর, মানুষের কাছে যেতে পারে। তবে এতটা পৌঁছে যাবে সেটা আশা করি নাই।
বাংলানিউজ: শ্রাবণের মেঘগুলো গান যেভাবে তৈরি হয়েছিল?
মেজবাহ রহমান: আমার চেয়ে গানটি সৃষ্টির গল্প তিনি (আশরাফ বাবু) ভালো বলতে পারবেন। তুমি যতটুকু শুনেছি, গানটি এক রাতে তৈরি হয়েছিল। তখন আমাদের প্রথম অ্যালবামের কাজ চলছিল, সে সময় ১২টি গান নিয়ে একটি অ্যালবামের প্রচলন ছিল। ১১টি গান রেকর্ড হওয়ার পর ১২ নম্বর গান ছিল এটা। শ্রাবণ মাসে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন সময় একদিন শেষ রাতের দিকে জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে তার মাথায় এল, এই শ্রাবণের বৃষ্টি নিয়ে একটা গান লিখলে কেমন হয়। আশরাফ বাবু লেখা শুরু করলেন, ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে, অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝরায়ে...’ এভাবেই হয়ে গেল ১২ লাইনের গানটি।
বাংলানিউজ: গানটি করার সময় ভেবেছিলেন এতটা জনপ্রিয়তা পাবে?
মেজবাহ রহমান: আশরাফ বাবুর মিউজিক সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। মনের মধ্যে সুর আছে ওটাই করত। ন্যাচারাল একটা বিষয় ছিল। আমরা আশা করেছিলাম ‘দৃষ্টি প্রদীপ’, আর ‘শ্রাবণের মেঘগুলো’ গানগুলো জনপ্রিয় হবে। তবে গানটি যে কালোত্তীর্ণ হবে এটা আমরাও সেভাবে প্রত্যাশা করিনি। কম্পোজিশন, কথা, গায়কী, রিদমসব কিছু একদম পারফেক্ট ছিল। যে কারণেই গানটি শ্রোতাদের মাঝে ক্লিক করেছে।
বাংলানিউজ: একটি গানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোন দিকগুলো?
মেজবাহ রহমান: গানের কম্পোজিশন গুরুত্বপূর্ণ। একটা অনেক সুন্দর গান হলেও ভালো কম্পোজিশন না হলে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তাই গানের কথা, সুর, কম্পোজিশন, গায়কী—সব মিলিয়ে একটা ভালো গান তৈরি হয়। গায়ক গেয়ে দিলেই একটা গান হয় না। এখানে গীতিকার, সুরকার, কম্পোজার সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলানিউজ: প্রথম অ্যালবামের মাধ্যমেই দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেলেন, এরপর নাকি বিরতি নিয়েছিলেন?
মেজবাহ রহমান: ১৯৯২ সালের দিকে গানের জগৎ থেকে কিছুটা সরে গিয়েছিলাম। উপন্যাস, রম্য রচনা, লেখালেখি শুরু করলাম। আবার ভাবলাম সিনেমা বানাব- এমন নানা পরিকল্পনা করতে থাকি। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। গানের দিকে সময় কমিয়ে দিলাম। কিন্তু মানুষ আমাকে ডাকে, তাদের চাওয়াতেই আট বছর পর ২০০০ সালে আবারও গানে ফিরে আসি। এরপর থেকে আছি। তবে এখনও মাঝেমধ্যে আমার মধ্যে ওই জিনিসগুলো নাড়া দেয়, খেলোয়াড় হতে পারিনি। আমার দুই ছেলে, চেয়েছিলাম ওরা খেলোয়াড় হোক, কিন্তু পড়াশোনা আগে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম দুটি একসঙ্গে হয় না, কারণ দেখবেন—অন্যান্য দেশে ছোটবেলাতেই ক্যাম্পে যোগ দেয়, যা আমাদের এখানে সেভাবে সম্ভব নয়। তাই ওরা পড়াশোনাই করছে। গানের গলাও বেশ ভালো, জেনেটিক্যালি হয়তো পেয়েছে। সবমিলিয়ে আমি সুখী। আমি খুব বেশি আশা করি না। ছেলেগুলো মানুষ হবে এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।
বাংলানিউজ: এই সময়ে ব্যস্ততা কী নিয়ে?
মেজবাহ রহমান: নতুন পাঁচ-সাতটি গান করেছি। আমার কাছে মনে হয়, সেগুলো ভালো হয়েছে। আমাদের জেনারেশনকে গানগুলোর সঙ্গে কানেক্টেড করতে পারব, কিন্তু আমাদের স্টাইলের গানতো এই প্রজন্মের সঙ্গে কতটা কানেক্টেড করতে পারব জানি না। কারণ তাদের টেস্ট আলাদা। মিউজিক ভিডিও করব। এরপর শিগগিরই গানগুলো ইউটিউব, ফেসবুক এসব প্ল্যার্টফর্মে প্রকাশ করব। এছাড়া নিয়মিত শো করছি, আমি রিইউনিয়ন অনুষ্ঠানগুলো বেশি করি। রেডি হওয়া গানগুলোও শোয়ে গাচ্ছি এবং ভালো রেসপন্সও পাচ্ছি।
বাংলানিউজ: আপনার বেশ কিছু গান তরুণ যারা ব্যান্ড করে কিংবা সলো কনসার্ট করে তারা গেয়ে থাকেন। নিশ্চয়ই আপনি অবগত, বিষয়টিতে আপনার কেমন অনুভব হয়?
মেজবাহ রহমান: তরুণদের অনেকেই আমাদের জনপ্রিয় গানগুলো করে। কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করে। রাজনীতি নামের একটি গান আছে আমাদের, সেটা দেখলাম আমাদের চেয়েও যারা নতুন করে গেয়েছে তাদের ভিউ বেশি। তবে তারা আমাদের ক্রেডিট দিয়েছে। আমাদের একটা সৃষ্টি এই সময়ের তরুণরা গায় এটা ভাবলে ভালো লাগে। তারা কেউ যোগাযোগ করলে আরও উৎসাহ দেই। অনেক সময় বলি, আমাদের চেয়েও ভালো করেছ।
বাংলানিউজ: নব্বই বা তার আগের চেয়ে বর্তমানে সময়ে ব্যান্ড মিউজিকের শ্রোতা বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে নতুন ব্যান্ডগুলো ফোকাস পাচ্ছে না পাওয়ার কারণ কী মনে হয়?
মেজবাহ রহমান: আগে বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিটিভি। নাটক দেখবেন, সবাই ওই একই নাটক দেখত। এখন এত মাধ্যম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে জায়গাটা একটা গণ্ডিতে নেই। নানা মাধ্যমে আপনি ব্যস্ত থাকছেন। টিভি মিডিয়াও আমার মনে হয় ডার্ক সাইটে চলে যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় অস্থির একটা সময় পার করছি। আমার কাছে মনে হয়, আগের সেই জোয়ারটা আর ফিরবে না। এই যে বইমেলা হয়, প্রচুর ভিড় হয় কিন্তু মানুষ পড়ে কতটুকু এটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমি বই পড়ার পাঠকতো দেখি না। আগে আমি নিজে পড়তাম, আর এখন সারদিন ইউটিউব, এটা-সেটা দেখে সময় কাটে। এখন ঘরে বসে আমাদের সবচেয়ে বেশি নষ্ট করছে এই মোবাইল ফোন। পরিবারের সদস্যদের মাঝে কথা হচ্ছে কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছেও না।
বাংলানিউজ: নতুনদের গান শোনা হয়?
মেজবাহ রহমান: সত্যি কথা বলতে নতুনদের গান সেভাবে শোনা হয় না। আমার গ্যাপ আছে। আমি ডেডিকেটেড না, আমার মাঝে অলসতা আছে। আমার যেমন প্রথম জীবনে মনে হয়েছিল খেলাধুলা করে নাম করব, তারপর কী মনে করে চলে আসছি গানে। আবার গানে বিরতি দিয়ে একটু লেখালেখিও করি। মুড চেঞ্জ হয়। হয়তো খুব শিগগিরই অন্যদিকে ব্যস্ত হব।
বাংলানিউজ: এরপরও নতুনদের জন্য পরামর্শ থাকবে আপনার পক্ষ থেকে?
মেজবাহ রহমান: যারা গান গাইতে চায় তাদের ফোকাসটা গানেই দিতে হবে। কারণ আমি নিজেকে চিন্তা করে বলি, এক সময় এত খেলাধুলা করতাম সবাই বলতেন, দেশের সেরা একজন খেলোয়ার হবো। অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি প্রচুর। কিন্তু আমাকে এখন গানের জগতের মানুষ হিসেবে চেনে। আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই, গানের জগৎ আমার ছিল না। তারপর কবিতা, উপন্যাস, রম্য রচনা লেখা শুরু করলাম। আবার চিন্তা করি একটা সিনেমা করব। তাই অন্যদেরকে বলি- যেদিকে যাবা নিজের ডেসটিনেশন আগে ঠিক করতে হবে। তাহলে ভালো কিছু করতে পারবে। চারদিকে গেলে কিছুই হয় না।
বাংলানিউজ: সবশেষ জানতে চাই- আপনি যে সময়ে শুরু করেছেন তুলনামূলক গানের সংখ্যা কম কেন?
মেজবাহ রহমান: আমার গানের সংখ্যা কম থাকার কারণ, যেই-সেই গান আমি করি না। অনেকেই বলে গান করতে, পছন্দ না হলে সরাসরি না করে দেই। সিনেমার গান আসছে কিন্তু গানের কথা পছন্দ হয়নি তাই গাইনি, তারা খুব অবাক হয়েছে। তারা বলেছে, গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে কথা লেখা, তারপরও বলেছি- আমার ভালো লাগেনি গাইব না। এজন্য অনেক গান আমার করা হয়নি। অল্প গান গেয়েছি, এতে মানুষ মনে করে যথেষ্ট। এই বয়সে এসে আর চাওয়া-পাওয়া কিংবা কোনও আফসোস নেই।
বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৫
এনএটি/এইচএ/