‘জিরো ডিগ্রী’ দেখলাম। এটা ঠিক রিভিউ না।
অবশ্যি ‘জিরো ডিগ্রী’র জন্য কিছু বাড়িয়ে বলার দরকার নেই। এটি আসলেই ভালো একটি সিনেমা। এর পরিচালক অনিমেষ আইচ। এর আগে তিনি জয়া আহসানকে নিয়ে কিছু চমৎকার কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে ‘বুমেরাং’ যারা দেখেছেন তারা জানেন অনিমেষ কি মানের নির্মাতা।
‘জিরো ডিগ্রী’র প্রধান চরিত্র : মাহফুজ আহমেদ, জয়া আহসান, রুহি।
ছবির ধরন: নহে আর্ট ফিল্ম, নহে হার্ড ফিল্ম।
মাহফুজ ও রুহির চমৎকার সংসার। একমুহূর্ত একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারে না এমন প্রেম। তাদের আট বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। আনন্দ আর খুনসুটিতেই তাদের দিন কাটে। অফিসের কাজে বিদেশ যেতে হয় রুহিকে। যাওয়ার সময় মাহফুজকে পা ছুঁয়ে সালাম করেন, জড়িয়ে ধরেন, বাচ্চাকে আদর করেন, কান্নাকাটিও করেন। ছেলেকে বলেন, ‘বাবা যা বলে মন দিয়ে শুনবা। ’ সে সময়ও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারে না এই মেয়ে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে প্রতারণা করছে। না তার স্বামী মাহফুজ আহমেদ, না দর্শক। সে তার নতুন প্রেমিকের চলে যাচ্ছে, ঘর সংসার স্বামী ছেড়ে। মর্মাহত হন মাহফুজ। রাগে ক্ষোভে একাকীত্বে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। সপ্তাহ ঘুরতেই তার একমাত্র ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। । এরপর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মাহফুজ। মানসিক হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি মেতে ওঠেন প্রতিশোধের নেশায়। রুহির প্রতারণায় পুরো সিনেমা হলে যেন ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে।
একই সাথে চলতে থাকে আরেকটি গল্প। জয়া আহসান আছেন সে গল্পে। তিনি নিজের প্রেমিক কর্তৃক প্রতারিত। প্রতারণার গল্প আপনারা হলেই দেখবেন। এই গল্পটা কিছুটা গতানুগতিক। প্রেমিক কতৃক প্রেমিকা বিক্রি। অতঃপর ধর্ষণ। জয়া আহসানও প্রতারণার শোধ নিতে মরিয়া। এতটুকুতেই ছবির বিরতি।
সিনেমার প্রথম অর্ধেক পুরোপুরি গল্পনির্ভর। প্রতারণার গল্প। শেষার্ধে শোধ, ক্রোধ, আর অ্যাকশন যা বলেন সব আছে। জেমসের ‘প্রেম ও ঘৃণা’ শিরোনামে ‘ভালোটাই দেখেছো দেখোনি ঘৃণার পাহাড়’ গানের কথা দিয়েই শুরু হয় প্রতিশোধ পর্ব। মাহফুজ আহমেদের অনবদ্য সংলাপ- ‘সে আমার পুরা জীবন নষ্ট করেছে। ওই কুত্তার বাচ্চাকে (তার স্ত্রী রুহি) দেশে এনে টুকরা টুকরা করব। ’ দর্শকও যেন এমন একটা গালি চাইছিলো। দর্শক উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে।
অন্যদিকে জয়ার গল্প। তিনি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকে। তার প্রতারক প্রেমিক কবিকে খুঁজে বেড়ায়। হোস্টেলের রুমমেট এক ছোট বোনের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদ পেতেছে তার প্রাক্তন প্রেমিক ওয়াহেদ। জয়া তাকে অনুসরণ করেন। ওয়াহেদ তার নতুন প্রেমিকাকে নিয়ে নষ্ট পাড়ায় যায়। জয়া তাকে অনুসরণ করেন। সে কি মেয়েটিকে বাঁচাতে পারে? ওয়াহেদেরই বা কী হয়? মাহফুজের স্ত্রী একসময় ফিরে আসে। তাকে কি মাহফুজ টুকরা টুকরা করে? জয়া আর মাহফুজের সম্পর্ক কী? সিনেমার বিনিয়োগ কারীদের স্বার্থে এতটুকু রহস্য গোপন রাখা নৈতিক দায়িত্ব। সেটা সিনেমা হলেই দেখুন।
অনিমেষ আইচের অনবদ্য গল্প, গল্প বলার ঢঙ, নির্মাণশৈলী ‘জিরো ডিগ্রী’কে অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে। প্রেম ও ঘৃণায় এতটা ক্ষোভ কোনো বাংলা পরিচালক আগে ক্যামেরায় আনতে পারেনি। যতক্ষণ সিনেমা হলে থাকবেন মাহফুজ আহমেদের স্ত্রীর প্রতারণার শোধ নেওয়ার জন্য আপনার ভেতরেও ক্রোধ কাজ করবে। পরিচালক ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। দর্শক যেভাবে মাহফুজের প্রতারক স্ত্রীকে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন পরিচালক ঠিক সেভাবেই গল্প এগিয়েছেন। পরিচালক বোধহয় জানতেন দর্শকের ক্ষোভ কোন জায়গায় এবং দর্শক কি চায়। এটাই তার সফলতা। ক্যামেরার কাজও ভালো ছিল। গল্পে অসাড়তা ছিল না। মাহফুজের একক গল্প দিয়েই সিনেমা হতো, পাশাপাশি জয়ার গল্প ভারসাম্য এনেছে। জেমসের গানের কথা আগেই বলেছি। হাবিব আর ন্যান্সির গান ভালো হয়েছে যথেষ্ট। গতানুগতিক সিনেমার মতো নাচ গান নেই এতে। কিন্তু বিনোদন আছে। ক্লাইমেক্স আছে। গল্প আছে। রক্ত আছে। গল্পই ছবিটিকে উতরে দিয়েছে। পরিচালক ঠকাননি দর্শকদের। যারা প্রথম অর্ধেক দেখতে ক্লান্ত (ক্লান্ত হবেন না আশা করি, তবুও বললাম) তারা শেষার্ধে মজা পাবেন।
লিও তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ১৫০ পাতা পড়ার পর মজা পেতে শুরু করেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। বারুদের গন্ধ নাকে পেতে শুরু করেছিলেন। ‘জিরো ডিগ্রি’র মজা পেতে আপনাকে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। হলে গিয়ে দেখুন। পয়সা উসুল হয়ে যাবে!
লেখক : অনলাইন এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময় : ১০৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৫