ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

আপনাকে কোথায় পাই হুমায়ুন ফরীদি!

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫
আপনাকে কোথায় পাই হুমায়ুন ফরীদি! হুমায়ুন ফরীদি (১৯৫২-২০১২)

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। দিনটা ঠিক মনে নেই।

উপলক্ষ্যটা ভোলার নয়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ‘মাতৃত্ব’ (২০০৪) ছবির জন্য সেরা অভিনেতা হয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। তা-ও প্রথমবার! শেষবারও! কৈশোর থেকেই তার অভিব্যক্তি, অট্টহাসি, ব্যক্তিত্বের ভক্ত হওয়ায় ফোন করার লোভ সামলানো গেলো না। ফোন ধরলেন তিনি। খবরটা জানাতেই খুশি হলেন। প্রশ্নের সুরে ‘আমি পেয়েছি?’ বলেই হাসলেন। তারপর বললেন, ‘বাসায় এসে মিষ্টি খেয়ে যেও। ’ 


সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে বারকয়েক কথাবার্তা হয়েছে। সামনাসামনি দেখাও হয়েছে। শেষদিকে তার হাতগুলোর কাঁপাকাঁপি চোখ এড়াতো না। তবুও তিনি সামনে দাঁড়িয়ে তাকালে মনে হতো কলেজের দিনগুলোর কোনো শিক্ষকের প্রতিমূর্তি! পর্দায় যার পরাজয়ে হাততালি পড়তো, বাস্তবে তাকে দেখলে আপনাআপনি শ্রদ্ধায় মাথা যেতো নুয়ে। এমন মানুষের কাছে নতজানু হওয়াটাও যেন ছিলো বড় ব্যাপার! হবেই বা না কেনো, আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে ক’জন অভিনয়শিল্পী মঞ্চ ও টিভি নাটককে জনপ্রিয় করেছিলেন, ফরীদি ছিলেন তাদের শীর্ষস্থানীয়। জীবদ্দশায় চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও মঞ্চে সমান দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্তের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছিলেন তিনি। নায়ক কিংবা খলনায়ক- সব চরিত্রেই সমান পারদর্শিতা দেখানো এই গুণী শিল্পী কাটিয়েছেন অভিনয়ের বর্ণাঢ্য জীবন।  

সেই মানুষটি আর নেই। ফাগুনের রঙে বিষাদ ছড়িয়ে তিন বছর আগে চিরতরে চলে গেছেন। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল সকালই ছড়িয়ে পড়ে সেই মরণ-খবর। পরদিন যথারীতি সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় চোখে পড়লো জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে ৬০ বছর বয়সে ফরীদির না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা। ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাও’- কথাটি মাঝে মধ্যে বলতেন হুমায়ুন ফরীদি। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্যেৎসবে তারুণ্যেই মানুষের দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি সবার হৃদয়ের অভিনেতা হয়েছেন। এখনও আছেন সবার হৃদয়ে। তিন দশকেরও বেশি সময় মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রং ছড়িয়ে গেছেন নন্দিত ও বরেণ্য এই অভিনেতা।

রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হুমায়ুন ফরীদি। নামফলক ছাড়া তাকে দেখার আর উপায় নেই। এটাই নিয়তি। একসময় সব অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু তার মতো মানুষ অদৃশ্য হবে কেনো? আরেকটু স্থায়ী হলে ক্ষতিটাই বা কী হতো। পৃথিবীর ওজন তো খুব একটা কমেনি তার প্রস্থানে! ফাগুন আসে, ফাগুন যায়; ফরীদি একবারই আসেন। এই ফাগুনের প্রাক্কালে হুমায়ুন ফরীদিকে কোথায় পাই? সে আফসোসের উত্তর হতে পারে নিচের তথ্যগুলো! 

* ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তার বাবার নাম এটিএম নুরুল ইসলাম, মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন স্নাতক করতে। কিন্তু পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় খাতা-কলম বাক্সবন্দি করে কাঁধে তুলে নেন রাইফেল। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে দামাল ছেলের মতো লড়াই করেছেন ফরীদি।

* স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক জীবন শুরু করেন হুমায়ুন ফরীদি। এখানেই তার অভিনয় প্রতিভার বিকাশ হয়েছিল। অর্থনীতির খটমটে তত্ত্ব বাদ দিয়ে সেলিম আল দীনের কাছে নাট্যতত্ত্বে দীক্ষা নেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই সদস্যপদ পান ঢাকা থিয়েটারের। এই নাট্যদল থেকেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার অভিনয়ের রঙগুলো। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদক।  

 

* নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা মঞ্চ- সবখানেই ছিল হুমায়ুন ফরীদির অবাধ বিচরণ। মঞ্চ দিয়েই শুরু। ঢাকা থিয়েটারের ‘শকুন্তলা’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’-এর মতো মঞ্চনাটকে অভিনয় করে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। আদায় করে নেন দর্শকের ভালোবাসা। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবে গ্রাম থিয়েটারের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হিসেবে শুধু রাজধানীতে নয়, বিভিন্ন জেলার মঞ্চেও অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।  

 

* মঞ্চের গণ্ডি পেরিয়ে টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রেও স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নেন হুমায়ুন ফরীদি। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। তার অভিনীত ধারবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ আজও দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর। এতে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। অন্য নাটকগুলোর মধ্যে আছে ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘শৃঙ্খল’, ‘প্রিয়জন নিবাস’। সর্বশেষ তিনি ‘তখন হেমন্ত’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন এবং ‘পূর্ণ চাঁদের অপূর্ণতায়’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন।

* ফরীদির নাট্যাভিনয় থেকে চলচ্চিত্রে আসা ছিল অনেক নাটকীয়। দেশীয় চলচ্চিত্রের তখনকার বেহাল অবস্থা দেখে রূপালি পর্দার জন্য কাজ করবেন কি-না এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সুবর্ণা মুস্তাফার অকুণ্ঠ সমর্থনে এবং নিজের দৃঢ়তায় এক নতুন আঙ্গিক নিয়ে বড় পর্দায় আসেন ফরীদি। তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ তার অভিনীত প্রথম ছবি। নব্বই দশকে বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘বীরপুরুষ’ ও ‘লড়াকু’ ছবিতে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপরেই দেশীয় চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্র পায় এক অন্যমাত্রা। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, একসময় মানুষ নায়কের পরিবর্তে তাকে দেখার জন্যই প্রেক্ষাগৃহে যেতো। তাই শহীদুল ইসলাম খোকন ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘অপহরণ’, ‘দুঃসাহস’সহ ২৮টি ছবির মধ্যে ২৫টিতেই রাখেন ফরীদিকে। তার অভিনীত ছবির তালিকায় আরও আছে ‘দহন’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দূরত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মাতৃত্ব’ ও ‘আহা!’র মতো ছবিতে অভিনয় করে এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেন ফরীদি।  

* বেশ কিছুদিন ফুসফুসের জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। এই গুণী শিল্পীর ব্যক্তিজীবন খুব বেশি সুখের ছিলো না। আশির দশকের শুরুর দিকে মিনুকে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম সংসারে দেবযানী নামের এক মেয়েকে রেখে গেছেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন ফরীদি। ২০০৮ সালে সেই সম্পর্কেরও বিচ্ছেদ হয়। পরের সময়গুলো অনেকটা নিঃসঙ্গ কেটেছে এই শক্তিমান অভিনেতার।  

 

* নানামুখী প্রতিভার এই অভিনেতাকে আর নতুনভাবে দেখা যাবে না টিভিতে, মঞ্চে কিংবা চলচ্চিত্রে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ দেশের অভিনয় ভুবনে একটি যুগের অবসান হয়। ৬০তম জন্মদিনে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লিয়ার’ নাটকে অভিনয়ের বাসনা জানিয়েছিলেন তিনি। নাটকটি আর করা হয়নি তার। কিন্তু জীবনের নানা পথপরিক্রমায় তার জীবনটাও যেন রাজা লিয়ারের মতো সুখে-দুঃখে ঘেরা! তবে যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তা আজীবন দর্শকের হৃদয়ে থেকে যাবে। ভক্তদের ভালোবাসায় হুমায়ুন ফরীদি অমর হয়ে থাকবেন।  


বিনোদন ও সংস্কৃতি বিষয়ক যাবতীয় যোগাযোগ এই ই-মেইলে : [email protected]

বাংলাদেশ সময় : ১৮২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।