মেধাস্বত্ত্ব অধিকার এবং ওয়েলকাম টিউন ডাউনলোডের চার্জ থেকে শিল্পী-সুরকার-গীতিকারদের বঞ্চিত হওয়া নিয়ে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ থেকে বাংলাদেশ মিউজিক্যাল রেগুলেটরি কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের একটি রেস্তোরাঁয় এক বৈঠকে এ দাবি তোলেন সংগীতশিল্পীরা।
গত ২৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ডাক ও টেলিযোযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংগীতশিল্পীদের বৃহত্তর অংশ একত্রিত হয়। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী- ২০১৭ সাল থেকে দেশীয় সংগীতাঙ্গনের নতুন-পুরনো সব শিল্পীকে অডিও কিংবা চলচ্চিত্রের নতুন গানের ক্ষেত্রে হাতেগোনা শিল্পী-সুরকার-গীতিকারদের সংগঠন বিএলসিপিএস (বাংলাদেশ লিরিসিস্টস কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি) অথোরিটি হিসেবে অনুমোদন দেবে।
বিএলসিপিএস’কে অথোরিটি দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে গান-বাজনা ছেড়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন সংগীতশিল্পীরা। এলআরবি ব্যান্ডের আইয়ুব বাচ্চু বলেছেন, ‘আমরা যারা গান-বাজনা করি, তারা এটা করেই জীবনধারণ করি। আমরা চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো কাজ করি না। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে অদ্ভুত একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে আমি মনে করি। তবে এটা কখনও সম্ভব নয়, অসম্ভব একটা সিস্টেম। ’
আইয়ুব বাচ্চু আরও বলেন, ‘আমরা যারা সংগীত করতে করতে জীবনটা শেষ করে দিয়েছি, মনে হয় না তাদের কেউ নিজের সৃষ্টি নিয়ে গান-বাজনার জন্য অনুমতি নিতে কাগজ নিয়ে কারও কাছে যাবে কিংবা ঘুরপাক খাবে। প্রয়োজনে সংগীতই ছেড়ে দেবো!’
সংগীতশিল্পীদের বেশিরভাগের দাবি, তাদের মতামত না নিয়েই এ পদক্ষেপ নিয়েছে বিএলসিপিএস। তাই ডাক ও টেলিযোযোগ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
প্রবীণ-নবীন সংগীতশিল্পীদের মতে, একটি সংস্থাই যদি সব অধিকার পায় তাহলে সরকারিভাবে গভর্নিং বডি করা হোক। গান-বাজনার সঙ্গে যারা আছেন, তাদের মধ্য থেকেই কয়েকজন ও সরকারি আমলা নিয়ে এ গভর্নিং বডি গঠন করা যেতে পারে বলে পরামর্শ এসেছে। সবার বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ভালো ফল আসবে, এমন আশাবাদ শোনা গেলো তাদের কণ্ঠে।
বাংলাদেশ মিউজিক্যাল রেগুলেটরি কমিশন গঠনের জন্য বরেণ্য চারজন কণ্ঠশিল্পী, নতুন প্রজন্মের চারজন শিল্পী, বরেণ্য চারজন গীতিকার, নতুন প্রজন্মের চারজন গীতিকার, বরেণ্য লোকসংগীত শিল্পী, তরুণ লোকসংগীত শিল্পী ও সংগীত সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাকে রাখার পরামর্শ নিয়ে একমত পোষণ করেছেন বৃহত্তর সংগীতশিল্পী সমাজ।
নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য অনেক শিল্পী এরই মধ্যে বৈঠকে বসেছিলেন। পরের প্রজন্মের জন্য সুন্দর জায়গা গড়ে দেওয়ার প্রয়াস থেকে একত্রিত হয়েছেন বলে জানান তারা। তবে এটাকে কোনো সংগঠন বলছেন না সংগীতশিল্পীরা। তাদের দাবি, এটা হবে এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে শিল্পীদের মিলন ঘটবে। এখান থেকে প্রবীণদের সঠিক দিক-নির্দেশনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন তারা। তারা পূর্বের মতো সংগঠন গড়া ও ব্যক্তিস্বার্থের পুনরাবৃত্তি চান না। ব্যক্তিগত ফায়দা হবে এমন সংগঠন তারা করবেন না।
সংগীতশিল্পীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘শিল্পীর ক্ষতি করে, এ প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মের ক্ষতি করে কেউ কিছু করলে তা আমরা মেনে নেবো না। যে নিয়ম চালুর অপচেষ্টা চলছে তাতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যারা গান-বাজনা নিয়ে স্বপ্ন দেখছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’
তরুণ সংগীতশিল্পী সাজেদ ফাতেমী বলেছেন, ‘আমরা শিল্পীরা একত্রিত হই না। এ সুযোগ নিয়ে কিছু ভুইফোঁড় সংগঠন দাঁড়িয়ে যায়, বেনিয়া গোষ্ঠী সুবিধা ভোগ করে। তাই এখন আর ভেদাভেদের সময় নেই। নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা তৈরি করতে আমাদেরকে একত্র হতেই হবে। ’
সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থ হওয়া গানের মানুষ লাকী আখান্দ, সেলিম আশরাফ ও শাহনাজ রহমান স্বীকৃতির প্রসঙ্গ টেনে বৈঠকে বলা হয়, সংগীতশিল্পীদের কোনো কল্যাণ তহবিল নেই। অথচ নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে ঠিকই একাত্মতা আছে। দোকান মালিক সমিতি কিংবা রিকশা চালক সমিতি থাকলেও শিল্পীদের কোনো নির্দিষ্ট কোনো ফোরাম নেই।
সংগীতশিল্পীদের সেই অর্থে কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই বলে অডিও শিল্পের স্থবিরতা কাটছে না বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। তাদের মতে, ‘শিল্পীদের কল্যাণে আমরা শিল্পীরা নিজেরাই কাজ করি না। শিল্পীদের একত্রিত হতে না পারার সুযোগে স্বার্থন্বেষী মহল মুনাফা লুটে নিচ্ছে। ’ এর পরিপ্রেক্ষিতে রেগুলেটরি কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হয়েছে।
একটি গান তৈরির জন্য গীতিকার-সুরকাররা এককালীন যে টাকা পেয়ে থাকেন তা খুবই নগন্য। কিন্তু এই একটি গানের যে মার্কেট আছে, তার সুফল পান না গীতিকার-সুরকাররা। অথচ রয়্যালটি যথাযথ পেলে একজন শিল্পীর পক্ষে একটি জনপ্রিয় গানের মাধ্যমেই সুস্থভাবে জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য প্রতি মাসে মোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজস্ব দিতে হবে, এমন দাবি তুলেছেন শিল্পীরা। তারা মনে করেন, সবাইকে একত্রিত হয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। তাদের মন্তব্য- শিল্পীদের মধ্যে বিভাজন থাকলে অডিও শিল্পের উন্নতি হবে না।
গানের কপিরাইট কারও কাছে না থাকার কারণেই এই সমস্যার উদ্রেক হয়েছে বলে মনে করেন বরেণ্য সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার নিজের গানই কপিরাইট না থাকার কারণে আদালতের স্বীকৃতি পায়নি বলেও জানান তিনি। তাই শিল্পীদেরকে তাদের সৃষ্টিকর্ম কপিরাইট করার ওপর জোর দেন ইমতিয়াজ বুলবুল। এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন তিনি।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী ২৫টি থেকে ৫০টি গানের কপিরাইট করতে গেলে ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেকের এ ব্যয়ভারের সামর্থ্য নেই, তাই গীতিকার আসিফ ইকবাল জানান, সরকারের কাছে এ বিষয়ে ফি মওকুফের আবেদন করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
আসিফ আকবর প্রত্যাশা নিয়ে বলেন, ‘এখানে যে আলোচনা হচ্ছে এবং এ আলোচনায় যারা অংশ নিতে একত্রিত হয়েছেন তারা আগামীতে অডিও শিল্পকে বেগবান করবেন, পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের জন্য কার্যকরী ভূমিকাও রাখবেন। ’
বৈঠকে আরও ছিলেন সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, সামিনা চৌধুরী, এস আই টুটুল, শহীদুল্লাহ ফরায়জী, কৌশিক হোসেন তাপস, মুহিন, পুলক অধিকারী, এফএ সুমন, শফিক তুহিন, লুৎফর হাসান প্রমুখ।
* শিল্পীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টার নামে অপচেষ্টার অভিযোগ
* শিল্পীর অনুমতি ছাড়া ওয়েলকাম টিউন নয়
বাংলাদেশ সময় : ১৭০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৬
জেএইচ