ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

তুমি উত্তম, অতি উত্তম

বিনোদন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৬
তুমি উত্তম, অতি উত্তম

কালজয়ী অভিনেতা উত্তম কুমারকে ঘিরে দুটি সংখ্যা সামনে হাজির। ৫০ আর ৯০।

উত্তম অভিনীত ‘নায়ক’ ছবিটি মুক্তির ৫০ বছরে পড়লো। অন্যদিকে মহানায়কের ৯০তম জন্মদিন পালিত হবে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর।  

উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের সফল অভিনেতা। পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। তাই দুই ভাষার শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা পেয়েছিলেন তার সান্নিধ্য।  

উত্তমের অভিনয় ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায়। জীবদ্দশায় বলিউড ও ওপার বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও মন্তব্য করেছিলেন তার কাজ নিয়ে। কেমন ছিলেন তিনি শোবিজ তারকাদের চোখে? মন্তব্যকারীদের কেউ কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তাদের কথাও রইলো এখানে।  

রাজেশ খান্না, অভিনেতা
আমার তো মনে হয় যেভাবে গোটা বাঙালি জাতির মুখ দেখা যেতো উত্তম কুমারের মধ্যে সেভাবে আর কেউ পারবে না নিজের জাতকে তুলে ধরতে। ওভাবে ধুতির কোঁচাই ধরতে পারবে না কেউ। যদিও আমার সঙ্গে উত্তম দাদার কোনো তুলনা হওয়া উচিত নয়। কারণ দু’জন দুই ঘরানার, দুই ভাষার, দুই মেজাজের নায়ক। তবু একই ছবির রিমেক হলে স্বাভাবিকভাবেই তুলনা এসে যায়। অন্তত দর্শক তো করেই। এখানে অবশ্য দায়িত্বটা আমার ওপর পড়ায় একটু বেশি কঠিন হয়ে গেলো কাজটা। তা কী আর করা যাবে! ‘অমর প্রেম’ সুপারহিট হয়েছিলো সবাই জানে, অনেকেই হয়তো বলবে আমি দুর্দান্ত অভিনয় করেছি, কিন্তু আমি নিজে জানি উত্তম কুমার আমার চেয়ে ১০০ মাইল এগিয়ে ছিলেন।  

শশী কাপুর, অভিনেতা
‘লাল পাথর’-এর সেই চিৎকার করে ‘আমাকে মুক্তি দাও’ সংলাপ বলার অনবদ্য কায়দাটা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। সেই যে উন্মাদ প্রেমিক, যে প্রেমিকার খুনরাঙা বেদি মুছতো আর হাহাকার করতো দিনরাত, উত্তম কুমার কী অপূর্বভাবে ফুটিয়েছিলেন! ফতেহপুর সিক্রির দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফেরা, তার আর্তনাদ আজও কানে বাজে। বাংলা আর হিন্দি দু’ভাষাতেই ছবিটা হয়েছিলো। দুটোই দেখেছি। তবে ‘লাল পাথর’-এর উত্তম কুমার আর ‘লাল পাথর’-এর রাজকুমারের কোনো তুলনাই চলে না। রাজকুমারের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে পুরোপুরি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে পারি, উত্তম কুমার অতুলনীয়।  

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা
অনেকেই ভাবেন আমি উত্তম কুমারের অভিনয়ের তীক্ষ্ম সমালোচক। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। তার মতো বড়মাপের অভিনেতা জীবনে খুব কম দেখেছি। আমি তার অভিনয়ের ভক্ত, গুণমুগ্ধ। আসলে কিছু ছবিতে ইমেজসর্বস্ব অভিনয় দেখে এই ভেবে ব্যথা পেয়েছি, এই হ্যাংওভারটা কাটিয়ে উঠতে পারলে তার অভিনয়ের মাত্রা কোন জায়গায় গিয়েই না পৌঁছুত! দুঃখটা পেয়েছি একজন গুণমুগ্ধ হিসেবেই। সমালোচনা করেছি উত্তম কুমারের অভিনয়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আছে বলেই।  

সুচিত্রা সেন, অভিনেত্রী
উত্তম আমার বন্ধু ছিলো। এক কথায় গ্রেট, গ্রেট আর্টিস্ট। তবু যেন মনে হয় তাকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি।  

মিঠুন চক্রবর্তী, অভিনেতা
এ রকম খাঁটি বাঙালি আমি কম দেখেছি। আমি নিজে ধুতি পাঞ্জাবি, কালোজিরা দিয়ে পারশে মাছের ঝোল, ঘরে পাতা দই- এসবই পছন্দ করি। তবু বলবো উত্তমদার মতো এমন ভাবনাচিন্তায়, হাঁটাচলায়, কথাবার্তায়, খাওয়া-পরায় বাঙালি বোধহয় কোনোদিন হয়ে উঠতে পারবো না।

গৌতম ঘোষ, চলচ্চিত্র নির্মাতা 
গৌরীশঙ্কর ও শঙ্কর সিং এই দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম যে কতোটা শক্তিমান অভিনেতা ‘ঝিন্দের বন্দি’ দেখেই উপলব্ধি করতে পারি।  

মাধবী চক্রবর্তী, অভিনেত্রী 
গঙ্গার বুকে আমি ও উত্তম- এই রোমান্টিক দৃশ্যটির কথা তখন দর্শকদের মুখে মুখে ফিরতো। ‘শঙ্খবেলা’ ছবিটি পরে আর দেখিনি। তবে সম্প্রতি টিভিতে ওই দৃশ্যটা আবার দেখলাম। সেখানে একটা কথা বুঝলাম উত্তম মারাত্মক অভিনয় করেছিলেন। এটা খুবই ঠিক ‘শঙ্খবেলা’ পুরোপুরি প্রেমের ছবি। আর প্রেমের ছবির ক্ষেত্রে নায়ক হিসেবে উত্তম কুমারের কোনো বিকল্প নেই। ’

তনুজা, অভিনেত্রী
শিল্পীদের মধ্যেই এমন কেউ কেউ থাকেন যারা অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রেরণা হয়ে থাকেন। যাদের মধ্যে কাউকে দেখে সাহস পাওয়া যায়। এক কথায় শিল্পীদের শিল্পী। উত্তম কুমার ছিলেন তাদের একজন।  

শত্রুঘ্ন সিনহা, অভিনেতা
সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তম কুমারের অভিনয় তুলনাহীন। আর ওকে ছাড়া যেন কাউকে মানাতও না ওই ভূমিকায়। ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটা বারতিনেক দেখেছি। ভালো অভিনয়ের ওই আরেক নমুনা। প্রায় প্রত্যেকটা চরিত্রই বেশ জটিল মানসিকতার। ‘গোলাপ কলোনি’ নামের আশ্চর্য বাগান-ডেয়ারিতে রহস্যের জট খুলতে ডাক পড়ে গোয়েন্দার। সেই গোয়েন্দার ভূমিকায় দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার।  

ডিটেকটিভ বলতেই আমাদের চোখে ভাসে ছিপছিপে, ধারালো, শক্তপোক্ত চেহারা। কিন্তু উত্তম কুমার তো ছিলেন এর ঠিক উল্টো। নরম-সরম, প্রেমিক-প্রেমিক, আদুরে চেহারা। তাহলে কীভাবে ‘চিড়িয়াখানা’য় সফল হলেন উত্তম? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন অবশ্য, কেনো সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক উত্তমকে বাছলেন? এ দুটো প্রশ্নের উত্তর আমার মনে হয় একই। উত্তম ভালো অভিনেতা ছিলেন বলে।  

এদেশের চলচ্চিত্র বিশেষ করে বাণিজ্যিক ছবি, অনেক ক্ষেত্রেই সংলাপ নির্ভর। সংলাপ বলার কায়দাটা উত্তম কুমারের স্টাইলের অন্যতম। আর সেই ঘাড় দোলানো। মন জয় করা হাসি। উত্তম কুমারের গোড়ার দিকের অভিনয়ে হলিউডি ছাপ পাওয়া যায়। পরে একান্ত নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করেছিলেন। হাঁটা, চলা, কথা বলা; সবটার মধ্যেই এমন আভিজাত্য ছিলো যে কিছুতেই এড়ানো যেতো না। অভিব্যক্তি ছোটাতে পারতেন নিখুঁতভাবে।  

বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা
যদিও উত্তমদার আদি অকৃত্রিম পরিচয় রোমান্টিক নায়ক হিসেবে, তবুও আমার মনে হয় ‘অবাক পৃথিবী’ ছবিতে তিনি যে চরিত্র চিত্রায়িত করেছিলেন, তারই প্রকাশ আমরা দেখেছি পরবর্তীকালের বিভিন্ন অ্যান্টি হিরোর মধ্যে। উত্তমদার অভিনয় মেপে দেখার যন্ত্র আমাদের কেনো, বিদেশেও আবিস্কৃত হয়নি।  

শক্তি সামন্ত, নির্মাতা
সংলাপ বলার নিজস্ব কায়দা ছিলো উত্তমবাবুর। শঙ্কর সিং আর গৌরীশঙ্করের দ্বৈত চরিত্রে, বিশেষ করে গৌরীশঙ্করের ভূমিকায় যেখানে এক শহুরে যুবাকে সাজতে হচ্ছে রাজকুমার, এখানে তিনি এককথায় অতুলনীয়। একজন মদ্যপ, নারীবিলাসী অথচ সাদাসিধে, আরেকজন বুদ্ধিমান, শিক্ষিত। এ কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ কাজ নয়।  

উত্তম কতো বড় অভিনেতা ছিলেন প্রতিভার বিচারে, তা মাপার চেয়ে আমার মনে হয় আজকের দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই যে, তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান অভিনেতা। অভিনয় ছিলো তার কাছে উষ্টদেবতার মতো, ফুল বেলপাতা চন্দন ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে মন এক জায়গায় স্থির রেখে অভিনয় করতেন তিনি। উত্তম যখন দাঁড়াতেন ক্যামেরার সামনে, বাইরের পৃথিবীর সুখ-দুঃখ যেন স্পর্শ করতো না তাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৬
এসও/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।