তাই রাজশাহীর একমাত্র সিনেমা হলটিও যেকোন সময় ভেঙে ফেলা হবে। সেখানে তৈরি হবে বহুতল ভবন।
বর্তমানে উপহার সিনেমা হলে দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো চলছে বাংলার সুপারস্টার শাকিব খান অভিনীত ‘নাকাব’ সিনেমাটি। ১২ অক্টোবর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এটিই হবে উপহার সিনেমা হলের শেষ প্রদর্শিত ছায়াছবি। এর পরে বন্ধ হওয়া রাজশাহীর অন্য হলগুলোর তালিকার শেষ নম্বরে যুক্ত হবে তিন দশকেরও বেশি পুরনো এই সিনেমা হলের নাম।
রাজশাহী মহানগরীতে প্রেক্ষাগৃহ ছিল মোট ছয়টি। এগুলোর মধ্যে উপহার সিনেমা হলটিই বেঁচে ছিল সিনেমাপ্রেমী কিছু দর্শকপ্রিয়তায়। আর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রেক্ষাগৃহটি ছিল রাজশাহীর ‘বর্ণালী’ সিনেমা হল। এর আসন সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৩। বতর্মানে ওই হলেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। মালিকের অনেক চেষ্টায়ও শেষ রক্ষা হয়নি মহানগরীর উপকণ্ঠে থাকা ‘রাজতীলক’ সিনেমা হলটি। দর্শক খরায় ২০১৪ সালে হলটি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ‘স্মৃতি’, ‘লিলি’ ও ‘উৎসব’ প্রেক্ষাগৃহ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর পুরনো ‘অলোকা’ হল পরে ‘স্মৃতি সিনেমা’ হল নাম হয়। ভিক্টোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাব ব্রিটিশ আমলে নাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে রাজা প্রমথনাথ ‘টাউন হল’ নামে এটি গড়ে তোলেন। হলটিতে বাংলা সাহিত্যচর্চা ও নাট্যচর্চা হতো। ১৯১৯ সালের ২ এপ্রিল ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাছ থেকে হলটি কিনে নেয় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সিনেমা প্রদর্শন করে আসছিলেন স্থানীয়রা। ২০০৭ সালে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়ে হলটি ভেঙে বহুতল বিপণী বিতান গড়ে তোলার কাজ শুরুর পর শেষ হয় ২০১২ সালে। স্মৃতি সিনেমা হল এখন নিজেই স্মৃতি হয়ে গেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে বাণিজ্যিক ভবন। তবে ওই এলাকাটি এখনও অলোকার মোড় বলেই পরিচিত।
মহানগরীর আরেকটি পুরনো সিনেমা হল ছিল ‘উৎসব’। আলুপট্টি এলাকায় থাকায় এই সিনেমা হলটির আগের নাম ছিল ‘কল্পনা’। পরে ‘উৎসব’ সিনেমা হল নামকরণ করা হয়। এই হলটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ‘রাজশাহী সিন্ডিকেট’ নামে ১৬ বিনোদন পিয়াসী এই সিনেমা হলটি চালু করেছিলের ‘কল্পনা’ নামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কল্পনার অংশীদাররা ভারতে পাড়ি জমান। স্বাধীনতার পর রাজশাহী সিন্ডিকেটের ম্যানেজার দীনবন্ধু দেশে ফিরে যোগসাজস করে সিনেমা হলটির নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন ঢাকাস্থ প্রয়াত মোশারফ চৌধুরীর কাছে।
তার মৃত্যুর পর সহোদর সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন রাজশাহীর রাজপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রহমানের কাছে। তিনি ‘কল্পনা’ নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন ‘উৎসব’। ২০১০ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এই সিনেমা হলটিতেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে ১৭ তলাবিশিষ্ট স্বচ্ছ টাওয়ার। তবে কল্পনার মোড় বলে ওই এলাকাটির নাম রয়েই গেছে।
এদিকে, পাকিস্তান আমলে মহানগরীর কাদিরগঞ্জ ও আমবাগান এলাকার মধ্যবর্তী এলাকায় বাবুল ও রুবেল চৌধুরীর উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘বর্ণালী সিনেমা’ হল। কাদিরগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা এই সিনেমা হলের নামেই এখনও এলাকাটি পরিচিত। ২০০৯ সালে সিনেমা হলটি কিনে নেয় ডেসটিনি-২০০০ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার। ২০১০ সালের শুরুতে সিনেমা হলটি ভাঙার কাজ শুরু হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই তা গুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির বহুতল ভবন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বর্তমানে স্থানটি ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে এখন মেলা বসে।
মহানগরীর বাইপাস এলাকার ‘লিলি’ সিনেমা হলটি ওই এলাকার বৃহৎ অংশের মানুষের বিনোদনের একমাত্র কেন্দ্র ছিল। টানা দুই বছর ধরে ব্যবসায় মার খাওয়ার পর লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিলি সিনেমা হলের প্রদর্শনীও বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ঐতিহ্যবাহী এ সিনেমা হলের জায়গাটি প্লট আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এভাবেই রাজশাহীতে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম সিনেমা হলগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। উপহার বন্ধ হলে কফিনের শেষ পেরেকটিও ঠুকে দেওয়া হবে।
সাড়ে ২৪ কাঠা আয়তনের এই জায়গায় একসঙ্গে এক হাজার পাঁচজন দর্শক সিনেমা উপভোগ করতে পারতেন উপহার সিনেমা হলে। প্রায় সাত বছর হলো এনালগ রিল সরিয়ে ডিজিটাল মেশিনের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। শ্রেণিভেদে টিকেটের দাম ১২০, ৭৫, ৫৫ ও ৪৫ টাকা। এখনও সকাল থেকে তিনটি শো চলছে হলটিতে।
সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক তপন কুমার দাস বলেন, মালিক চায় না বলে এ হলে আর সিনেমা চালানো হবে না। ১২ অক্টোবর থেকে এটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। হলটি মালিকের ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাই হলটি ভেঙে কী বানাবেন তিনি ভালো জানেন।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, এ সিনেমা হল মালিক যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই করতে পারবেন। এটা তার ব্যাপার।
এদিকে, রাজশাহী মহানগরীর শেষ সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। হলটি ভাঙার প্রতিবাদে বিকেলে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে রাজশাহী ফ্লিম সোসাইটি ও রাজশাহী ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটিসহ সমমনা সংগঠনগুলো।
রাজশাহী ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ডা. এফএমএ জাহিদ বলেন, রাজশাহী শিল্প-সংস্কৃতিতে অনন্য। সেই ঐতিহ্যের শহরে একটি প্রেক্ষাগৃহ থাকবে না এটি সংস্কৃতিমনা কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই যেকোনো আন্দোলনের মাধ্যমে হলটি রক্ষা জরুরি। প্রয়োজনে সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় হোক, সিটি করপোরেশন হোক বা জেলা পরিষদই হোক এটি কিনে নিয়ে ঐতিহ্য রক্ষা করা উচিত।
এদিকে, রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি ড. আতাউর রহমান বলেন, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য অশনি সংকেত। একটা সময় ছিলো যখন সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় হতো। কিন্তু দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। ভালো সিনেমার অভাবে সিনেমা হলগুলো দর্শক খরায় ভোগে। ভালো সিনেমা তৈরি হলেই দর্শক আগ্রহের সঙ্গে হলে যাচ্ছে। সম্প্রতি তৈরি কিছু সিনেমা মানুষ বেশ আগ্রহের সঙ্গেই দেখছে। দর্শক আকর্ষণ করতে হলে শিল্পের মানও ভালো হতে হবে।
রাবি নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি বলেন, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত ছবির অভাবে চরম লোকসানের মুখে পড়ছে সিনেমা হলগুলো। তাই দেশের অবশিষ্ট হলগুলো বাঁচাতে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আরও গবেষণা করতে হবে, ভালো মানের সিনেমা তৈরি করতে হবে। এছাড়া দর্শক ফিরিয়ে আনতে আধুনিকতম চলচ্চিত্র হল (সিনেপ্লেক্স) তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৮
এসএস/আরআর