ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

গানে গানে পৃথিবী বাঁচুক: শুভেন্দু মাইতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৯
গানে গানে পৃথিবী বাঁচুক: শুভেন্দু মাইতি

প্রখ্যাত সঙ্গীত গবেষক ও গণসঙ্গীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতি। পশ্চিমবঙ্গের ৭৫ বছর বয়সী গুণী এই ব্যক্তিত্ব জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন লোকসঙ্গীত সংগ্রহ, চর্চা, প্রচার-প্রসারে। লোকগানের এই কাণ্ডারিকে নিয়ে ঢাকায় দু’দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কৃষ্টি ফাউন্ডেশন। শনিবার (২৭ জুলাই) ধানমন্ডির ছায়ানটে এবং বুধবার (৩১ জুলাই) রাজশাহীতে ‘বাংলা গানের পরম্পরা’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাইবার পাশাপাশি লোকসঙ্গীতের নানাদিক নিয়ে কথা বলবেন শুভেন্দু। তার আগে লোকগান-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপ করেছেন তিনি।

বাংলানিউজ: দীর্ঘদিন ধরে আপনি লোকগান তথা আমাদের সংস্কৃতির শেকড় রক্ষায় কাজ করে আসছেন। এমন উদ্যোগে কীভাবে উৎসাহী হলেন? 
শুভেন্দু মাইতি: এক জীবনে আমি অনেক কিছুই দেখেছি।

সেই দেখাগুলোই আমার চিন্তা-চেতনা তথা ভাবনার উপকরণ। মনে পড়ে, আমার বাবা বস্তার মধ্যে আলাদা করে কিছু ধান রাখতেন। মানে, বীজ ধান। জমিতে ফেলার জন্য রাখতেন। ঘরের সব ধান শেষ হয়ে গেলেও এই ধানে হাত দেওয়া যাবে না। না খেয়ে থাকলেও হাত দেওয়া যাবে না। কারণ ধানের বীজটাই যদি খেয়ে ফেলি ধান চাষ করবো কীভাবে! বাকি সারা বছর খাবো কী? বাবা এভাবে ভাবতেন। এই ভাবনাটা আমার মাথায় বাসা বাঁধে পরবর্তী সময়ে। যখন বুঝতে পেরেছি, আমাদের সাড়ে তিন হাজার ধানের বীজ হারিয়ে গেছে। আমাদের ধান আমরা হারিয়ে ফেলেছি হাইব্রিড ধানের দৌরাত্ম্যে। অর্থাৎ, হাইব্রিড খেয়ে ধানের সঙ্গে গিলে ফেলছি গানের বীজও।

শুভেন্দু মাইতি।  ছবি: রাজীন চৌধুরীবাংলানিউজ: বিষয়টা যদি একটু খোলাখুলি করে বলতেন-
শুভেন্দু মাইতি: আমি বলছি, মূল জিনিসটা ধরে রাখতে হবে। মানে, আজকাল লোকগান যে যার মতো করে গাইছে। ড্রাম-গিটার বাজিয়ে গাইছে। সুর বিবৃত করে গাইছে। গানের চেয়ে যন্ত্রকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে গাইছে। আর এদিকেই আমরা ঝুঁকে পড়ছি। অপসংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি। এভাবে চলতে থাকলে একদিন মূল সুরটাই থাকবে না। এসব চিন্তা থেকে মূল সুর ঠিক রাখার প্রয়াসে আমি লোকগান নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হই।

বাংলানিউজ: লোকগানের মূল সুর-রক্ষা তথা গবেষণার জন্য ‘লালন আকাদেমি’ গড়েছেন। তো, মূল সুর-রক্ষা এবং গবেষণার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন? সেই পদক্ষেপের প্রয়োগ ঘটাতে পারছেন কতটুকু?
শুভেন্দু মাইতি: তা জানি না। তবে চেষ্টা তো করছি। হয়তো হচ্ছে। হয়তো হবে না। তবে কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে। আমি এগিয়ে এসেছি। ‘লালন আকাদেমি’তে লালন’সহ মূল সুরের ১৬ হাজার লোকগান আর্কাইভ করে রেখেছি। আর্কাইভ করে রেখেছি গুগলেও। ‘লালন আকাদেমি’ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও মূল সুরের গান থেকে যাবে।

বাংলানিউজ: লোকগানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কী কী উদ্যোগ অত্যাবশ্যক বলে আপনি মনে করেন?
শুভেন্দু মাইতি: লোকগান সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। একাডেমি গড়তে হবে। একাডেমির মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে গান সংরক্ষণ করতে হবে। অঞ্চলভেদে অনেকে নতুন নতুন লোকগান বানায়। তাদের খুঁজে বের করতে হবে।

বাংলানিউজ: লালনের গানকে অনেক আগে থেকেই অনেকে নিজের মতো করে গাইছেন। তার গানের মূল সুর কোনটা, বোঝার উপায় কী?
শুভেন্দু মাইতি: সুরের বিষয়টা অনেকে না জেনে করছে। এর জন্য জানতে হবে। গান জানার-সাধনার বিষয়। শুধু গাইলেই হবে না। লালনের গান করার ক্ষেত্রে শিল্পীকে আগে গানের নেপথ্যের সব বিষয় জানতে হবে। লালন ছাড়াও তার অনেক গানের সুর করেছেন দুন্দু শাহ ও পাঞ্জু শাহ। তাদের এবং লালনের সুরে গান করেন ফরিদা পারভীন। এই সময়ের শিল্পীরা লালনের গানের জন্য তাকে আদর্শ মনে করতে পারেন।

বাংলানিউজ: আরেকটা বিষয় হচ্ছে, শিল্পীভেদে লালনের গানে শব্দের পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। এর কিছু যৌক্তিক কারণ নিশ্চয় আছে?
শুভেন্দু মাইতি: কিছু যৌক্তিক কারণ তো আছেই। যেমন, লালন এবং তার গান নিয়ে গবেষণা করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের অসংখ্য গানের মধ্যে ২৬টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন। এই ২৬টি গানের কোনো না কোনো জায়গায় শব্দের পরিবর্তন করেছেন তিনি। সহজে বোঝার জন্যই রবীন্দ্রনাথ এই কাজটি করেছিলেন। যে কারণে এই বিষয়টাকে নেতিবাচকভাবে না নিয়ে ইতিবাচকই মানতে হচ্ছে!

শুভেন্দু মাইতি।  ছবি: রাজীন চৌধুরীবাংলানিউজ: কবীর সুমন, নচিকেতা, রাঘব, অঞ্জন, তপন, কাজী কামাল নাসের, লোপামুদ্রার মতো শিল্পীরা আপনার হাত ধরেই উঠে এসেছেন। তাদের মধ্যে কবীর সুমনের সঙ্গে আপনার পরিচয় এবং কীভাবে তাকে দিয়ে গান করালেন, বলবেন?
শুভেন্দু মাইতি: ১৯৮০ সালের পর থেকে বাংলা গানের খরা চলতে শুরু করলো। তখন আমি নতুন নতুন গান এবং শিল্পীর সন্ধানে ব্যস্ত। ১৯৯০ সালের দিকে আমার এক বন্ধু গিটার হাতে সুমনের গান শোনে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। গান শুনে আমাকে তার কথা বললো। দীর্ঘ ছয় মাস খোঁজার পর পেলাম তার ঠিকানা। এরপর একদিন তার ভবানীপুরের ভাড়া বাসায় গিয়ে কড়া নাড়লাম।  
সেদিনই সুমনের সঙ্গে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা গান-কবিতা ও গল্প নিয়ে আড্ডা দেই। বিশেষ করে তার গান শুনে অবাক হই। মনে হয়েছিল, এই গান বাঙালির কাছে পৌঁছানো দরকার। এরপর সুমনকে তার কিছু গান রেকর্ড করে আমাকে দেওয়ার জন্য বলি। সে দেওয়ার পর গানগুলো আমি এইচএমভিতে জমা দিই। তাদের আশ্বস্ত করি, এই গানগুলো মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলবে। তারা গান শুনে খুব পছন্দ করে।
এরপর ১৯৯১ সালের নভেম্বরে কোনো এক তারিখে সকাল ১১টা থেকে সুমনের গানের রেকর্ডিং শুরু হয়। চলে রাত ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে (একদিনে) ১৩টি গান রেকর্ড করা হয়। সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পায় সুমনের প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। প্রকাশের প্রথম এক মাসেই ২ লাখ ৫০ হাজার ক্যাসেট বিক্রি হয়। পরের ইতিহাস তো সবারই জানা।  

বাংলানিউজ: ৭০ বছর বয়স আপনার। জীবনের এই পর্যায়ে এসে কোন বিষয় নিয়ে বেশি ভাবেন?
শুভেন্দু মাইতি:  রাজনৈতিক অস্থিরতা-অবক্ষয় দূর হোক। গানে গানে পৃথিবী বাঁচুক। অবক্ষয় দূরীকরণে শিল্পীসমাজ এগিয়ে আসুক। পৃথিবীজুড়ে থাকা হে ৩২ কোটি বাঙালি, সন্তানকে বাংলা গান শেখাও। বাংলা লোকাচার শেখাও। শেকড়ের গল্প জানাও-শেখাও।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১৯
ওএফবি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।