ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

বাবা কথা রেখেছিলেন

সোহেল আরমান, নাট্যনির্মাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
বাবা কথা রেখেছিলেন আমজাদ হোসেনের সঙ্গে তার ছেলে সোহেল আরমান

বাবাকে দেখি না আজ দু’বছর হয়ে গেল। তবুও বাবার স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।

কখনো হাসায়, কখনো বা কাঁদায়, কখনো বা আনমনা করে দীর্ঘক্ষণ। ছোটবেলা থেকেই বাবার অন্যতম সঙ্গী ছিলাম আমি। ঘরে বা বাইরে সবখানেই। সুযোগ পেলেই বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। এখনও দাঁড়িয়ে দেখি বাবা কী করে হাসছেন, কথা বলছেন, শুটিংয়ে কান্নার দৃশ্য দেখে কীভাবে কাঁদছেন।  

আমি এখনও অনুভব করি বাবা কতটা বিশাল সমুদ্রের মতো। বাবার হৃদয় জুড়ে কত কোটি কোটি অগণিত আকাশের তারা ছিল। এমন কোনো মানুষ দেখিনি যে কিনা বাবাকে ভালোবাসতেন না। আজও মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে যখন বিএফডিসিতে (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) ঢুকতাম তখন একটু পর পর বাবাকে দেখে সালাম দিত সবাই, এ যেন এক দীর্ঘ সালাম বিনিময়। তখন থেকেই বুঝতাম বাবাকে সবাই ভালোবাসেন। কেন ভালোবাসেন? তার কারণ একটি-দু’টি নয়, সে এক বিশাল ব্যাপার।  

বাবা যে অমর কাজগুলো করে গেছেন তারই পুরস্কার হলো এই দেশের মানুষের ভালোবাসা। আসলে বাবাকে নিয়ে কথা বলা যেন নদীর ঢেউ গোনা। যেমনি সাহিত্যে, গল্পে, কবিতা-উপন্যাসে তেমনি চলচ্চিত্র, নাটক ও গীত রচনায়- কোথায় নেই বাবা? শুধু তাই নয় ব্যক্তি হিসেবে বাবা একজন সৎ, সাহসী আর বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। আমি বাবাকে এখন ভীষণ মিস করি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার একটা বিশাল বটবৃক্ষ ছিলেন, সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় আমি মনের আনন্দে খেলতাম পড়তাম ঘুরে বেড়াতাম।  

আজ সেই বাবা নামের বটবৃক্ষটি আর নেই। বাবা ছিলেন আমার বন্ধুর মতো। মিডিয়াতে বেশিরভাগ মানুষই আমাকে আর বাবাকে একসঙ্গে দেখতেন। কারণ বাবা পঞ্চাশ পেরোবার পর থেকে আমাকেই তার একান্ত সঙ্গী হিসেবে কাছে রাখতেন। কেন জানি বাবা আমাকে সঙ্গে রাখতেই খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।  

আমি আর বাবা কতবার যে লং ড্রাইভে গিয়েছি তা আর গুণে রাখা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ সময়ই আমরা লোকেশন দেখতে যেতাম। আমি ড্রাইভিং সিটে আর বাবা তার পাশের সিটে বসতেন। গাড়ি চালাতে চালাতে কত যে আড্ডা বাবার সঙ্গে, কত হাসি কত গান আজও সেই দৃশ্যগুলো আমার চোখের সামনে সূর্যের প্রখর আলোর মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। গানের কথা কেন বললাম, কারণ বাবার ছবির সব বিখ্যাত গানগুলো বাবার অনুরোধে আমি গেয়ে গেয়ে শোনাতাম। বাবা আমার গান শুনে কাঁদতেন, আবার কখনো আনন্দে আপ্লুত হতেন। প্রকৃতপক্ষে বাবা একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন। দেশপ্রেমের গানগুলো বাবাকে বেশি আবেগ আপ্লুত করতো।  

আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার একবার ডিপথেরিয়া হলো। তখন বাবা কোনো কাজে যশোরে ছিলেন। এদিকে আমার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় আমাকে মহাখালী শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমি শুধু বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম টানা একদিন। পরদিন আমি অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ি, আমার দু’চোখে শুধু ঘুম… তারপর বিকেলের দিকে আমি চোখ মেলে তাকাতেই দেখি বাবার মুখ। কী এক মায়া নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন বাবা। তার চোখ থেকে বড় বড় পানির ফোঁটা আমার বুকে এসে পড়ছিল।  

আমি তখন বাবাকে বলেছিলাম, বাবা আমার ভয় হচ্ছে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। বাবা চোখ মুছে বলেছিল আরে বোকা তুই ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি আছি না? যতদিন বেঁচে থাকবো আমি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোর পাশেই থাকবো।  

হ্যাঁ, বাবা কথা রেখেছিলেন। ব্যাংককে বাবা যখন আইসিইউতে মৃত্যুশয্যায়, তখনও এই একলা আমি বাবার পাশেই ছিলাম আর কেউ ছিলেন না। বাবা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন। অনেক ভালোবাসি বাবা তোমাকে, আমিও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোমাকে ভালোবেসে যাবো।

**দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনকে হারানোর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে সোমবার (১৪ ডিসেম্বর)। ২০১৮ সালের এইদিনে ৭৬ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কিংবদন্তি। আমজাদ হোসেনকে স্মরণ করে তাকে নিয়ে বাংলানিউজের কাছে স্মৃতিচারণ করলেন তারই কনিষ্ঠ পুত্র ও নাট্যনির্মাতা সোহেল আরমান।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।