দেশীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯ তুলে দেওয়া হয়েছে বিজয়ীদের হাতে। এ বছর চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখায় যুগ্মভাবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ও অভিনেত্রী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা।
রোববার (১৭ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ৪৪তম আসরে উপস্থিত হয়ে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন চিত্রনায়ক সোহেল রানা। কিন্তু অভিনেত্রী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা উপস্থিত না থাকলেও তার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেছেন তার মেয়ে।
পুরস্কার গ্রহণের পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘জীবনের প্রথম পুরস্কার নিয়েছিলাম আজকের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে। আজও ভেবেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কারটি নেবো, যে কারণে ৬ মাস পরে বাসার বাইরে বের হয়েছি। এসে শুনলাম ওনার হাত থেকে পুরস্কার নিতে পারছি না, তবুও উনি আমার সামনে আছেন, ওনাকে সালাম জানাচ্ছি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন জানতে পারলাম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আমাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে, তখন আমার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। হৃদয়ের মাঝখানে আমার মনে হলো একটা দুঃখবোধ চলে এলো। কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারলাম না সেই দুঃখবোধটা কেনো! চলচ্চিত্র জগতে আমি গত ৪৬ বছর ধরে কাজ করছি, এ সময়ে এসে চলচ্চিত্র জগতে আমার যতটুকু পাওনা ছিল, আজ বোধহয় তার ইতি হয়ে গেল। সে কারণেই হয়তো দুঃখবোধটা।
সম্মাননাটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উৎসর্গ করে এই কিংবদন্তি অভিনেতা বলেন, ‘৪৯ বছর আগে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১জন’ আমি প্রডিউস করেছিলাম। হয়তো বঙ্গবন্ধু আমাকে স্নেহ করতেন, তাই তিনি সিনেমাটি দেখেছিলেন। সেসময় যখন আমি ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে যাই, তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, ‘ভালোই তো বানাইছস, এখানে থেকে যা। ’ আমি সেই গুরুবাক্যকে চিরধার্য্য মনে করে চলচ্চিত্র জগতেই রয়ে গেলাম। এরপর দ্বিতীয় সিনেমা করলাম মাসুদ রানা এবং এরপর থেকে আমার ইতিহাস…। ’
সোহেল রানা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন না বলতেন, তুই চলচ্চিত্রে থেকে যা, আজকে সারা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মানুষ আমাকে চিনতেন না। তাই আজকের এই দিনে আমি যে পুরস্কারটি পেয়েছি, তা জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমার শিক্ষা গুরু, আমার রাজনৈতিক গুরু, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তার পায়ের কাছে সম্মাননাটি উৎসর্গ করলাম। ’
এ অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
দেশীয় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর প্রযোজক ছিলেন। কিন্তু পরে নায়ক খ্যাতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার প্রযোজক পরিচয়টি।
১৯৪৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ সোহেল রানা নাম ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে মাসুদ পারভেজ নামে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন।
১৯৭৩ সালে সোহেল রানা নাম ধারণ করে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র ‘মাসুদ রানা’র একটি গল্প অবলম্বনে ১৯৭৪ সালে ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং একই সিনেমার মাধ্যমে তিনি মাসুদ পারভেজ নামে পরিচালক হিসেবেও যাত্রা শুরু করেন।
‘এপার ওপার’, ‘দস্যু বনহুর’, ‘জীবন নৌকা’- এভাবে একের পর এক প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
সোহেল রানার নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পারভেজ ফিল্মসের ব্যানারে ৩০টির অধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলো হলো- ওরা ১১ জন, মাসুদ রানা, গুনাহগার, জবাব, যাদুনগর, জীবন নৌকা, যুবরাজ, নাগ পূর্ণিমা, বিদ্রোহী, রক্তের বন্দী, লড়াকু, মাড়কশা, বজ্রমুষ্ঠি, ঘেরাও, চোখের পানি, ঘরের শত্রু, গৃহযুদ্ধ, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, শত্রু সাবধান, খাইছি তোরে, ভালোবাসার মূল্য কত, অন্ধকারে চিতা, ভয়ংকর রাজা, ডালভাত, চারিদিকে অন্ধকার, রিটার্ন টিকিট ও মায়ের জন্য পাগল। গুণী এই নায়কের ছেলেও এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকেই নির্মাণ করেন ‘অদৃশ্য শত্রু’ নামের চলচ্চিত্র।
এর আগে আরও তিনবার সোহেল রানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২১
জেআইএম