বাংলা চলচ্চিত্রের বহু গল্পে যে খলনায়ককে বারবার নায়িকাদের তুলে আনতে কিংবা পুলিশের অফিসার হয়েও ‘উপর মহল’-এর নির্দেশে নায়িকাদের ওপর নির্যাতন চালাতে দেখা গেছে তার নাম ‘গাঙ্গুয়া’। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ পারভেজ হলেও তাকে সিনেমাটিক ‘গাঙ্গুয়া’ ছদ্মনাম দিয়েছিলেন প্রয়াত অ্যাকশন হিরো জসিম।
৪৩ বছরের অভিনয় জীবনে এখন পর্যন্ত ৮০০ ছবির ওপরে নাম অভিনয় করেছেন। বর্তমানে হাতে একদম কাজ নেই। অভিনয়ে ফিরতে চান। সে ফেরাটা হয়ে উঠছে না সিনেমা সংকটের কারণে। তাই ব্যস্ত সময় কাটছে ইউটিউবের ছোট চলচ্চিত্রে কাজ করে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে নিজের নেপথ্য জীবনের গল্প শোনালেন গাঙ্গুয়া। শুরুতেই জানালেন ‘গাঙ্গুয়া’ নামের পেছনের কাহিনি। তিনি বলেন, ‘আমি যখন প্রথম অভিনয়ে আসি, তখন জসিম ভাই বললেন এখন থেকে ‘গাঙ্গুয়া’, এইটাই তোমার নাম। আমি বললাম, এইটা কেমন কথা, এইটা নাম হইলো? জসিম ভাই বললেন হ্যাঁ এইটাই নাম, দ্রুত তোমাকে মানুষ চিনতে পারবে এই নামে। জসিম ভাইয়ের কথাই ঠিক হলো। দ্রুত আমাকে মানুষজন চিনলো। বাংলাদেশে গাঙ্গুয়া একটাই নাম আমার, আমি গর্ব করি। '
এখন সময় কীভাবে কাটছে? গাঙ্গুয়া বলেন, 'এখন তো হাতে সিনেমা নেই। আসলে সিনেমা হলই নেই। সিনেমা হল ভেঙে সবাই মার্কেট করছে। যার কারণে আমাদের দর্শকেরা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত, আর মাঝখানে চলে এলো করোনা। আমার এক বড়ভাই বন্ধুর জিম আছে। সেখানে গিয়ে জিম করি, শরীর ফিট রাখি। আমাদের শরীর ফিট না রাখলে তো চলবে না। জিম করলে মনে আনন্দ লাগে। তাই জিম করে বিকালটা কাটে। আর স্ট্রোক করার পর থেকে নিজের স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে খেয়াল রাখি। আমার একমাত্র মেয়ে ফারজানা ঢাকার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিচার। তার সাথে গল্প করি। এভাবেই তো চলে যাচ্ছে সময়। '
গাঙ্গুয়া কয়েক বছর আগে ফিল্ম ক্লাবে ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন। নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্কয়ার হাসপাতালে। সেখানে অনেকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। আপনাকে পরিচালকেরা আর ডাকছেন না, সেজন্যই কি আপনি ইউটিউবে ব্যস্ত? এমন প্রশ্নের জবাবে গাঙ্গুয়া বলেন, 'আমি ২০২০ সালে শেষ সিনেমা করেছি। আসলে ইউটিউবের ভাইরা আমাকে ডাকে, বলে আপনি একটু অভিনয় করে দিলে আমাদের উপকার হয়। সেজন্যই ইউটিউবে কাজটা করি। আর আমাকে তারা খুব পছন্দ করে তাদের যদি একটু উপকার হয় তাতে আমার ক্ষতি কী? বরঞ্চ ভালোই লাগে। '
১৯৭৮ সালে ঢাকাই সিনেমায় পা রাখা গাঙ্গুয়ার তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনই অভিনয় করে যেতে চান। তারপরেও বললেন, 'আসলে শিল্পীদের জীবনের শেষে যোগফল শূন্য। আগে আমাদের লেখাপড়া কম ছিল। না বুঝেই যে কোনো কিছু করতাম। শুধু অভিনয় করে জীবনের শেষে এসে এজন্য কষ্ট সইতে হয়। অবশিষ্ট বলে কিছু থাকেনা। কারণ অভিনয় সেক্টরে পেনশনের ব্যবস্থা নেই। শিল্পী চলচ্চিত্রে ৫০ বছর কাজের পর আরও ৩০ বছর বাঁচলে ওই পরের সময়টা তার কষ্টে কাটে। কারণ তার সঞ্চয় থাকেনা। জীবনটা কষ্টে কাটে। এজন্য খারাপ লাগে। তবে মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়েছি। '
পর্দার চরিত্র নিয়ে কথা হয় গাঙ্গুয়ার সঙ্গে। এই যে আপনি নায়িকাদের তুলে আনতেন, ধর্ষণ দৃশ্যে কাজ করতেন- এসব দৃশ্যে কাজ করতে গিয়ে নেতিবাচক কোনো অভিজ্ঞতা? গাঙ্গুয়া একদম সপ্রতিভ, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তার ক্লান্তি নেই। বললেন, 'আমাকে পরিচালক যে দৃশ্যে যথাযথ মনে করেন সেই চরিত্রে আমি অভিনয় করি। আমি তো বহু সিনেমায় পুলিশ অফিসার চরিত্রেও অভিনয় করেছি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খারাপ পুলিশ অফিসার ছিলাম। একবার নায়িকা মুনমুনকে তুলে আনতে গেছি। তুলে আনার আগে নির্যাতন করবো। আমার মুখে চুরুট থাকবে। ঠিক সেভাবেই মুখে চুরুট নিয়ে নায়িকার চুলের মুঠি ধরেছি। এরপর খুব হেসে মুখ বাড়িয়েছি, মাথায় ছিল না যে মুখে আমার চুরুট। চুরুটের আগুন গিয়ে পড়লো মুনমুনের শরীরে। এরপরের ঘটনা আর না বললেও চলবে, তখন ভিলেন আমি না মুনমুনই হয়ে উঠেছিলেন। '
গাঙ্গুয়ার জন্ম উত্তরবঙ্গের জয়পুরহাটে। আট ভাই, চার বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। দীর্ঘদিন কাজ করার পর ১৯৯২ সালে নজরুল পরিচালিত ‘মাস্তান রাজা’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন এই অভিনেতা। তার স্ত্রী গৃহিণীর পাশাপাশি একজন বিউটিশিয়ান।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২১
এমকেআর