আহমদ ছফা, বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী। জাতীয় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে বাঙালি মুসলিম সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত লেখক দানিয়েল ও ক্যান্সারে আক্রান্ত তায়েবার ভিতরকার অস্ফুট প্রেম, টানাপড়েন আর যুদ্ধ নিয়ে নানা মত উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে। সে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে একই নামের চলচ্চিত্র, যা সারাদেশে মুক্তি পেয়েছে গত শুক্রবার (১৯ মার্চ)। সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন নবাগত পরিচালক হাবিবুর রহমান।
চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, আহমেদ রুবেল, আজাদ আবুল কালাম, মাহতাব হাসান, নুসরাত জাহান জেরীসহ আরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত্ব পড়ুয়া এক ঝাঁক শিক্ষার্থীবৃন্দ।
আহমদ ছফার ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যান। ‘অসির চেয়ে মসি বড়’- তাই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে তিনি কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। সে সময় সমস্ত স্মৃতিকে নিজ জবানিতে কলমবন্দী করে তিনি ‘অলাতচক্র’ শিরোনামে তা একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করেন।
উপন্যাস তথাপি চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্র দানিয়েল মূলত লেখকের নিজেরই প্রতিচ্ছবি। অলাতচক্র মানে হচ্ছে আগুনের চক্র বা বৃত্ত। লেখক নিশ্চিতভাবে তার জীবনকে আগুনের বৃত্তে দাঁড় করিয়েছেন উপন্যাসটির নামকরণের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে ‘অলাতচক্র’ কেনো গুরুত্বপূর্ণ? আমার কাছে এর দুটি উত্তর রয়েছে। প্রথমত ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি ফর্মেট) চলচ্চিত্র নির্মাণ নি:সন্দেহে এ দেশের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম এবং প্রয়াসটিকে কতকটা সফল বলাই চলে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে উপন্যাসনির্ভর চলচ্চিত্রের সংখ্যা এখনো চাইলে হাতে গোনা যায়। উপমহাদেশে যেখানে ইতোমধ্যে নায়ক-নায়িকা নির্ভর ‘চটকদার’ চলচ্চিত্রকে পেছনে ফেলে চলচ্চিত্রের গল্পই বনে যাচ্ছে আসল নায়ক! সেখানে বাংলাদেশে গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
২০১৭–১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে শুরু হয় চলচ্চিত্রটির কাজ। তবে এর আগে ছয় বছর ধরে চলেছে এর চিত্রনাট্য লেখার কাজ। এতে হাবিবুর রহমানের প্রযোজক ছিলেন তার মা রহিমা বেগম।
এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে, চলচ্চিত্রটিতে লিউকোমিয়া আক্রান্ত রোগী তায়েবার চরিত্রে বরাবরের মতো দারুণ অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। অভিনেত্রী হিসেবে তার নিজেকে প্রমাণের আর বোধকরি কিছু বাকি নেই। তবে দানিয়েলের চরিত্রে আহমেদ রুবেলকে কিছুটা বয়স্ক লেগেছে, সঙ্গে তার চরিত্রে ফুটে উঠেছে খানিকটা মঞ্চসুলভ অভিনয়। বাকি পার্শ্বচরিত্রে ভালো করেছেন আজাদ আবুল কালাম, জেরীসহ অন্যান্যরা। বিশেষত চলচ্চিত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দেখানো মুনির চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের মহড়ার দৃশ্যে অভিনেতাদের অভিনয় এক কথায় লা জবাব।
চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্প মাধ্যম যেখানে দর্শকই সব। বহির্বিশ্বে ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণ মূলত কোনো একটি উদ্দেশ্যের উপরভিত্তি করে হয়ে থাকে। সেটি হতে পারে দর্শককে কোনো রোমাঞ্চকর কাহিনীতে আটকে ধরা কিংবা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি। সেই পরিমাপে ‘অলাতচক্র’ কেনো থ্রিডি ফর্মেটে নির্মিত হলো তা চলচ্চিত্র দর্শনে বোধগম্য হলো না। তবে পরিচালকের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে দর্শকদের বিশেষ এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
ওইদিকে ঐতিহাসিক দলিলে দেখা যায়, ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থী শিবির ও হাসপাতালে ঠাঁই ধারণের যায়গা ছিল না। সেখানে ফাঁকা হাসপাতাল এবং উপন্যাসের চরিত্র তায়েবার জন্য নার্স, ডাক্তারের অত্যধিক যন্ত্রাদি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সমর্থন করে না। সর্বোপরি এমন উপন্যাসের সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্রে রূপান্তর কতটা অর্থবহ সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেল। কিন্তু দিন শেষে যেটা চলচ্চিত্রের প্রতি ফ্রেম জুড়েই দেখা গেল তা এর প্রতি পরিচালকের মমত্ববোধ। এজন্যই বোধকরি চলচ্চিত্রটি শেষ অবধি দেখা সম্ভব হয়েছিল।
পরিশেষে পরিবেশক জাজ মাল্টিমিডিয়াকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এমন এক ব্যতিক্রমী নির্মাণের পাশে এসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রেক্ষাগৃহ জোগাড় করে দেবার জন্য। এমন নিয়মিত পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমে একদিন এদেশের চলচ্চিত্র একটি নিজস্ব ধারা খুঁজে নেবে, এমন দিনের প্রত্যাশায়...
প্রচলিত রয়েছে, ‘যাকে ধরে আহমদ ছফা, তার হয় দফা রফা!’
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২১
জেআইএম