বাংলা লোকসংগীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন আবদুল আলীম। পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি গানের শিল্পী হিসেবে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি।
আবদুল আলীমের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আবদুল আলীমের ছেলে সংগীতশিল্পী জহির আলীম জানান, জন্মদিনের দিন সকাল ৯টায় গুণী এই শিল্পীর কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এছাড়া সকলের কাছে বাবার জন্য দোয়া চেয়েছেন তিনি।
এদিকে আবদুল আলীমের ছোট মেয়ে সংগীতশিল্পী নুরজাহান আলীম ফেসবুকে স্ট্যাটাসে জানান, আবদুল আলীমের গানকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘পল্লী সম্রাট আবদুল আলীম ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন করছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি চাইবো আপনারা সবাই আমার পাশে থাকবেন এবং আমার এই সংগঠনটিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করবেন। সংগঠনটি শুধু আমার একার নয়, এটা সবার কারণ আবদুল আলীম তিনি শুধু আমার বাবাই নন, তিনি এদেশের জাতীয় সম্পদ। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমার এই প্রচেষ্টা। সবাই আমার এবং আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। ’
বাল্যকাল থেকেই আলীম সংগীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন আবদুল আলীম। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তিনি শুনে গান শিখতেন; আর বিভিন্ন পালাপার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালাপার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ ও ‘আফতাব আলী বসলো পথে’। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোকসংগীতের এক অবিসংবাদিত-কিংবদন্তি পুরুষ।
আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে আছেন আবদুল আলীম। লোক সঙ্গীতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার ঢেউ যেন আছড়ে পড়ে শ্রোতার বুকের তটভূমিতে। মানুষের মনের কথা, প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলিয়ে যে গানের সুর আবদুল আলীমের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতো, তা শুধু এই বাংলা ভাষাভাষীদের মনেই নয়; বিশ্বের সকল সুর রশিক যারা, বাংলা ভাষা জানেন না- তাদেরও আপ্লুত করতো।
দেশভাগের পর আবদুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। এ ছাড়া তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’।
সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল আব্দুল আলীমের। এছাড়া স্টুডিও রেকর্ডেও তার অসংখ্য গান রয়েছে। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখী’, ‘মেঘনার কুলে ঘর বাঁধিলাম’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘দোল দোল দুলনি’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘কেনবা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাবো মদীনায়’ কেহ করে বেচা কেনা কেহ কান্দে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’ প্রভৃতি।
সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আবদুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন আবদুল আলীম। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে। এছাড়া ১৯৯৭ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০২২
এনএটি