ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ভালো নেই সুন্দরবন

মাহবুবুর রহমান মুন্না, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩
ভালো নেই সুন্দরবন

খুলনা: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো আগলে রাখে, ঝড়-ঝাঁপটাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাক থেকে আমাদের রক্ষা করে। অথচ সেই সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য নানা কারণে রক্ষা হচ্ছে না।

মানুষের অত্যাচারে ভালো নেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল 'সুন্দরবন'। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং দুর্যোগে হুমকির মুখে পড়েছে বনের প্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্য। পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় অসচেতনতা, অবহেলা এবং সর্বোপরি মানুষের ক্রমাগত অত্যাচারে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে এ বন। সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা কেটে নিচ্ছে গাছ। শিকার করা হচ্ছে বাঘ ও হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী।

২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক ডজন হরিণ শিকার ও দুটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যার খবর পাওয়া গেছে। এসব অনিয়ম বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বন বিভাগ। এদিকে সাগরের পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বাড়ায় কমে যাচ্ছে সুন্দরী গাছ, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। জেলে সেজে বনে গিয়ে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে কমে যাচ্ছে মাছের পরিমাণও।

ঝড়-ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবন এক সাহসী যোদ্ধা। ঢাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সৈনিকের মতো। সুন্দরবন রক্ষা করেছে উপকূলীয় লাখো মানুষের জীবন, তাদের বাড়িঘর, পশুপাখি, বেঁচে থাকার একান্ত সম্বল। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা।

প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিছক একটি বন নয়, এটি একটি ইকোসিস্টেম। এর নদ-নদী, চারিদিকে ঘিরে থাকা বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের এক অনন্য সম্পদ। অথচ অত্যাচার-অনাচারে জর্জরিত বিশ্ব প্রকৃতির বিরলতম সম্পদ বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ক্রমাগত অস্তিত্ব সংকট-ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার অতীত ঐতিহ্য। দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য।

বিশ্বে যে ১৩টি দেশে বাঘ রয়েছে এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা বাড়ার লক্ষণ দেখা গেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূল পরিবেশ, নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে শুধু বাঘ নয়, বনের সামগ্রিক জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনে জীবনযাপনে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি সাগরে পানির লবণাক্ততা বাড়ার ফলে মিষ্টি পানি পানে অভ্যস্ত বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মারা যাচ্ছে।

সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ক্রেতা সেজে ৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া কেনার ফাঁদ পেতে তিনজনকে আটক ও একটি বাঘের চামড়া জব্দ করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বিকেলে উপজেলার হরিনগর বাজার সংলগ্ন ধলপাড়া গ্রামের শেখ হাফিজুর রহমানের বাড়ি থেকে বাঘের চামড়াটি উদ্ধার করেন র‌্যাব-৬ এর সাতক্ষীরা ক্যাম্পের সদস্যরা।

রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে একটি বাঘের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কলাগাছির মুরালীখাল এলাকা থেকে বাঘের মরদেহটি উদ্ধার করে লোকালয়ে আনেন বনবিভাগের সদস্যরা।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এ বন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে মায়ের মতো। উপকূলের কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখলেও নিজে ভালো নেই সুন্দরবন। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণী শিকার ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ শতাংশই হচ্ছে সুন্দরবন। প্রায় ছয় হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছ। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্ত প্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ।

সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়ে আসছে সুন্দরবন দিবস। যার ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবার সুন্দরবন দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব ভালবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসার আহ্বান জানিয়ে এবারও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় পালিত হচ্ছে সুন্দরবন দিবস। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হবে।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সুন্দরবন দিবসে বেলা ১১টায় খুলনা প্রেস ক্লাবের হুমায়ুন কবীর বালু মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। খুলনা প্রেস ক্লাব ও সুন্দরবন একাডেমির যৌথ উদ্যোগে এবারে খুলনায় কেন্দ্রীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস উদযাপন করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরায় সুন্দরবন একাডেমি এবং বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান স্বদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে আজ( ১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের ম্যানগ্রোভ সভা কক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম।

মোংলা উপজেলায় সুন্দরবন একাডেমি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’র যৌথ আয়োজনে সুন্দরবন দিবস উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে শিশুদের সুন্দরবনভিত্তিক চিত্রাঙ্কন ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সকালে উপজেলা পরিষদ থেকে শোভাযাত্রা এবং বিকেলে শহীদ মিনার চত্বরে আলোচনা সভা।

শরণখোলায় সুন্দরবন একাডেমি এবং শরণখোলা প্রেস ক্লাবের যৌথ আয়োজনে সুন্দরবন দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন শরণখোলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী।

এদিকে দাকোপে সুন্দরবন একাডেমির আয়োজনে আলোচনা সভা চালনা পৌরসভা ভবনে অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন চালনা পৌরসভার মেয়র সনত কুমার বিশ্বাস।

এছাড়া বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ সুন্দরবন সংলগ্ন অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় স্থানীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের সুরক্ষা এখন সময়ে দাবি। এ বনের ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ দরকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষায় সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। যার জন্য সুন্দরবন বিষয়ক পৃথক মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালনের দাবি আমাদের দীর্ঘ দিনের।

রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালনের সরকারি কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন দিবসের চেয়ে সুন্দরবনের জন্য কী করে যেতে পারলাম সে বিষয়েই আমি বেশি আগ্রহী। ভার্চ্যুয়ালের দিকে আমি কম আগ্রহী। বাস্তবে সুন্দরবনের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই আসল বিষয়। নাম তো যে কেউ একটা দিতে পারে।

জানা যায়, ২০০১ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন। নানান প্রতিকূলতা পেরিয়ে সাফল্য পাওয়া সে সম্মেলনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ২০০১ সালের সেই সুন্দরবন সম্মেলনের পরের বছর থেকেই খুলনাসহ সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোয় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সুন্দরবন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এ দিবস পালনের কর্মসূচিতে সংযুক্ত থাকে সুন্দরবন একাডেমি, বন বিভাগ, বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুন্দরবন সংলগ্ন সাংবাদিক সমাজ এবং প্রকৃতিপ্রেমী আপামর মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৩
এমআরএম/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।