লামা (বান্দরবান): মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কায় শঙ্ককিত হয়ে পড়েন বান্দরবানের লামা পৌর শহরবাসী। রাতে না ঘুমিয়ে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হয়; কখন জানি বন্যার পানি তলিয়ে দেবে বসতঘর, ব্যবসা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ!
ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয় লামা উপজেলা প্রশাসনসহ শহরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
বর্ষা মৌসুম এলেই চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় লামাশহরবাসীকে। ধীরে ধীরে এ বন্যা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শহরবাসী। ফি বছর সামান্য বৃষ্টিতে লামা বন্যাকবলিত হওয়ার জন্য ৩টি কারণকে দায়ী করা হচ্ছে।
লামা শহরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ‘ইতোপূর্বেকার প্রস্তাবিত পথে মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের বিকল্প নেই। ’ সে কারণে দ্রুত এ প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসীসহ স্থানীয় প্রশাসন।
জানা যায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টা মুষলধারে বৃষ্টি নামলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর দু’কুল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে। এতে শহরের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পানিতে তলিয়ে যায়।
আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহানোর পাশাপাশি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালামাল সরাতে চরম হিমশিম খেতে হয় মালিক-কর্মচারীর। বেশির ভাগ সময় মালামাল সরাতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
এছাড়া পাহাড়ি ঢলে পলি পড়ে হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চলতি বছরের বর্ষায় পর পর ৩ বার লামা শহর এলাকা প্লাবিত হলে জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।
এতে সরকারি হিসাব মতে, প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। স্থানীয়রা সমান্য বৃষ্টিতেই লামা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার ৩টি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
তাদের মতে, যুগ যুগ ধরে পাথরের বেষ্টুনী দিয়ে গড়ে ওঠা পাহাড়গুলো থেকে অবৈধভাবে পাথর আহরণের ফলে বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকহারে পাহাড়ে ধসের সৃষ্টি হয়।
ধসেপড়া পাহাড়ের মাটি ও বালি বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাহাড়ি ঝিরি বেয়ে মাতামুহুরী নদীতে পড়ার কারণে অস্বাভাবিকভাবে নাব্যতা হারিয়েছে মাতামুহুরী; যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই মাতামুহুরী পরিপূর্ণ হয়ে দু’কূল উপচে বন্যার সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে জুম চাষের কারণে অগ্নিসংযোগ এবং অব্যাহতভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে পাহাড়গুলো ‘ন্যাড়া’ পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। ন্যাড়া পাহাড় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারায়। একারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত পাহাড় বেয়ে নেমে এসে বন্যার সৃষ্টি করে।
অপরদিকে, লামা বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত সুখো এবং দুঃখো নামের দুটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মাতামুহুরী নদীটি প্রবাহিত। পাহাড়ি ঢলের পানি এ দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত হতে না পেরে ফুঁসে উঠে বন্যার সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে লামা শহর প্লাবিত করে।
জানা গেছে, বন্যার কবল থেকে লামা শহরকে রক্ষার জন্য মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের একটি প্রকল্প ইতোপূর্বে হাতে নেওয়া হয়।
সে প্রকল্প অনুযায়ী, লামা বাজার থেকে ১ মাইল উত্তরে অবস্থিত মাতামুহুরী ও বমু নদীর সঙ্গমস্থল থেকে নদীর গতি পরিবর্তন করে দিলে বন্যার কবল থেকে লামাবাসীকে মুক্ত করা সম্ভব। এ স্থান দিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত পাহাড়ি ঝর্ণা কেটে দিলেই এ গতি পরিবর্তন সম্ভব।
এ বিষয়ে প্রবীণ ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বান্দরবান জেলার সাধারণ সম্পাদক এম রুহুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, “প্রস্তাবিত পথে গতি পরিবর্তনের ফাইলটি দীর্ঘ বছর ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হিমাগারে পড়ে আছে।
অথচ সরকারের মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা একাধিকবার নদীর গতি পরিবর্তনের এলাকাটি সরেজমিন পরিদর্শন করে লামাবাসীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষার আশ্বাস দিলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ’’
লামা বাজারের ব্যবসায়ী পলাশ কান্তি দাশ জানান, বাজারেই তার বাসা। মুষলধারে বৃষ্টি নামলে বন্যার আশঙ্কায় মা, বাবা ও ভাই বোনদের নিয়ে বসে থাকেন কিংবা পরিবারের মূল্যবান জিনিসপত্র সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, “মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তন বাস্তবায়িত হলে লামা শহর যেমন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতো, তেমনি নদীর বর্তমান অংশে বাঁধ দিলে প্রায় ৩ মাইল এলাকা জুড়ে মনোরম প্রাকৃতিক লেক তৈরি হতো, যা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উল্ল্যেখযোগ্য অবধান রাখতে পারতো।
এছাড়া মাছচাষের মাধ্যমে এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে অন্যখানে বিক্রি করাও সম্ভব হতো।
ব্যবসায়ী পলাশ কান্তি দাশ, ওষুধ ব্যবসায়ী দিলীপ কান্তি দাশ ও নবীর উদ্দিনসহ আরও অনেকের মতে, শিগগিরই লামা শহরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আগামী বর্ষা মৌসুমগুলোতে পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হয়ে লামায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় সৃষ্টি হতে পারে।
লামায় ঘন ঘন বন্যার কথা স্বীকার করে উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘শহরকে বন্যামুক্ত করতে প্রস্তাবিত নদীর গতি পরিবর্তন ছাড়া কোনো উপায় নেই। নদীর গতি পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। ’’
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫,২০১২
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর