সিলেট: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রকাশনায় সাতকরার বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস ম্যাক্রোপটেরা (Citrus macroptera)। কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ নয়, আংশিক নাম।
তার দেওয়া পূর্ণাঙ্গ নাম সাইট্রাস ম্যাক্রোপটেরা মনট্রুজ (Citrus macroptera Montrouz. Var. annamensis Tanaka) নামেই বর্তমান সময়ে গবেষকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে সাতকরা।
প্রফেসর নেছাওর মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন সাতকরার ওপর গবেষণা করে।
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের ৭ম ব্যাচের কর্মকর্তা প্রফেসর নেছাওর মিয়ার গবেষণা টাইটেল ছিল (Biology, Phytochemistry and in vitro Propagation of Citrus macroptera (Satkara)।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে তিনি সাতকরা গবেষণায় নিয়ে সরাসরি তথ্যভিত্তিক কথা বলেছেন। ড. নেছাওর বলেন, সাতকরা ভারতের আসাম অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার ফল। এটি উত্তরপূর্ব অঞ্চল শেলা, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মনিপুর রাজ্যে জন্মায়। এক্ষেত্রে (দাস ও কুমার ২০১০) একটি ভারতীয় বইয়ের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন তিনি।
সিলেটের সীমান্ত অঞ্চল জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট শ্রীমঙ্গল অঞ্চলেও এ ফল জন্মায়। তবে এসব অঞ্চলে এখন আর সাতকরার উৎপাদন নেই বলেও তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এটির পাতা অন্য সব লেবু জাতীয় ফলের পাতার চেয়ে এতই ভিন্ন যে, একমাত্র পাতা দেখেই সাতকরা গাছ চেনা সম্ভব। পাতা সুস্পষ্টভাবে বড় দু’টি অংশে বিভক্ত। শাখার সঙ্গে যুক্ত একটি অংশ। একমাত্র সাতকরার প্রথম অংশটি বড়। যা অন্য কোনো সাইট্রাস বা লেবু জাতীয় ফলে দেখা যায় না। তাই সাতকরা গাছ একমাত্র পাতা দেখেই চেনা সম্ভব।
বর্তমানে সাতকরার উৎপাদন কমে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এর উৎপাদন খুব সময় সাপেক্ষ। সঙ্গে প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত অঞ্চলে এখন বাণিজ্যিকভাবে আর সাতকরা চাষ হচ্ছে না। বাজারে যে সাতকরা পাওয়া যায় তার প্রায় সবটাই ভারত থেকে আমদানি করা।
সাতকরার বংশবৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি বলেন, বীজ থেকে ফল আসতে অনেক দেরি হয়। এতে প্রায় ১৫-১৬ বছর সময় লাগে। তবে গাছটি ভালোও হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে।
এ জন্য বীজ থেকে এর বংশবৃদ্ধি না করে কলম পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। শাখা কলম বা টি-বাডিং পদ্ধতিতে বেশি করা হয়। কিন্তু এর সমস্যা হচ্ছে যেখানে জোড়া দেওয়া হয় সেখানে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে।
এ পদ্ধতিতেই আপাতত এর উৎপাদন ও বংশবৃদ্ধি করা হয়। ধারাবাহিক কোনো গবেষণা না থাকায় এর ভালো উৎপাদন পদ্ধতি এখনো উদঘাটন করা যায়নি।
তিনি বলেন, কলম পদ্ধতি শুধু জাম্বুরা দিয়ে করা হচ্ছে। কিন্তু অন্যান্য সাতকরা জাতীয় ফল যেমন আদালেবু দিয়ে করা হলেও সফলতা আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি সাতকরার সুগন্ধির যথেষ্ট অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, এর প্রাকৃতির ফ্লেভার বা সুগন্ধি বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে ২৫টি উপাদান আছে।
বাংলাদেশে সাতকরা চাষের বিপুল সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদে যত্নশীল হলে সাতকরা চাষ লাভজনক হতে পারে। নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ আসলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। নতুন জাত উদ্ভাবনে তিনিও আগ্রহী বলে জানান।
তিনি বলেন, সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পেলে এমসি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ কাজ করতে পারবেন তিনি।
সাতকরা সিলেট অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে উল্লেখ করে প্রফেসর নেছাওর বলেন, সিলেটে অতিথি আপ্যায়নে সাতকরার সুনাম আছে। সাতকরা দিয়ে হরেক রকম আচার তৈরি হচ্ছে। বিদেশেও যাচ্ছে সাতকরা। প্রবাসীরা ইংল্যান্ডেও সাতকরার চাষবাদ করতে আগ্রহী। তাই সাতকরা নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ। সাতকরা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
গবেষকের পরিচয়:
গবেষক প্রফেসর ড. নেছাওর মিয়া বালাগঞ্জের বেগমপুরের শরৎ সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, সিলেট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, এমসি কলেজ সিলেট থেকে সাবসিডিয়ারি শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স, ১৯৮৪ সালে উদ্ভিদ প্রজনন বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএস-সি। এ ছাড়া, ২০০৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এরপর ২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওভারহ্যাম্পটন থেকে পোস্ট ডক্টোরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
নেছাওর ওসমানীনগর থানার সাদিপুর ইউনিয়ন সাদিপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী আবুল হোসেন ও মিসেস শফিকুন নেছার একমাত্র পুত্র। তিনি নিজে দু’পুত্র সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী নাজনিন নাহার নাজু ক্যাথলিক মিশন রোডস্থ শ্রীমঙ্গলের অধিবাসী আবদুল মতলিবের কন্যা।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৩
এসএ/এসএইচ/এইচএ/আরআইএস