তালা (সাতক্ষীরা) থেকে: ভোটের আগে নানা কথা শুনি, এই হবে, সেই হবে। আমাদের আর পানিতে ডুবতে হবে না।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কানাইদিয়া, গঙ্গারামপুর, ভবানীপুরসহ জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়লেন স্থানীয় সাংসদের ওপর।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের কাছে এইসব এলাকার মানুষ তাই একটাই দাবি, যেভাবেই হোক পানি সরান। আর পানি সরাতে কপোতাক্ষ নদ খননের দাবি জানান তারা।
সূত্র বলছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১১-১১ অর্থবছরে কপোতাক্ষ নদ খননের বিষয়টিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রকল্পটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ওপর। এক বছর পর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পপের নাম দেয়া হয় ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)’। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। ৪ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পটির জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। ৪ বছর মেয়াদী প্রকল্পটি অনুমোদনের পর ২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অর্থ ছাড়ে দেখা দিয়েছে গড়িমসি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের কাজ বন্ধ আছে। বর্তমানে জমি মালিকদের ক্ষতি পূরণের টাকা দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া শেষ করে খুব দ্রুত টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। এরপর খনন করা হবে কপোতাক্ষ।
তবে এলাকাবাসী বলছে, কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এ এলাকায় জলাবদ্ধ পরিস্থিতির ক্রমান্বয়ে অবনতি হচ্ছে। এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পটি নিয়ে আশায় বুক বাঁধলেও কপোতাক্ষ তীরের লাখো মানুষ বসবাস করছেন চরম সঙ্কটে। কপোতাক্ষ নদের উপচে পড়া পানিতে তালা উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১০০টি গ্রামের ১৮ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় বসবাস করছেন। বিশেষ করে নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানির মধ্যে বসবাস করছে মানুষ। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় বসবাস করলেও এখনও এলাকায় যাননি স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কপোতাক্ষ তীরবর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি এখন রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিগত নির্বাচনের আগের সময়ের সঙ্গে জলাবদ্ধ এলাকার বর্তমান অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। নির্বাচনের আগে হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে মানুষের আড্ডায় তাই সব ক্ষোভ সংসদ সদস্যের ওপর। পাঁচ বছরেও ‘তালা-কলারোয়া’ আসনের সংসদ সদস্যের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার এর প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
খলিলনগর ইউনিয়নের পাকারমাথা এলাকার রবিউল ইসলাম জানান, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য কপোতাক্ষ খননের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ছিলেন। শুনেছি কপোতাক্ষ খননের বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু এমপির কারণে তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে না। এছাড়া এমপি জলাবদ্ধ এলাকায় আসেন না। কয়েক বছরে এলাকায় তার দেখা মেলেনি। ’
ইসলামকাটি গ্রামের নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করে বলেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার আগে জনপ্রতিনিধিরা কত কথাই বলে। নির্বাচিত হওয়ার পরে তা আর মনে রাখে না। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে কপোতাক্ষ খননের আশ্বাস দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য। কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। এলাকায় জলাবদ্ধতা রয়ে গেছে। ’
তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান জানান, কপোতাক্ষ খনন প্রকল্পের আওতায় প্রথমে পাখিমারা বিলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও নামে মাত্র বাঁধ দিয়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। আর কপোতাক্ষ নদের খনন এখনও শুরুই হয়নি। এজন্য জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্টরাই দায়ী। কারণ সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পটি ঠিকমতো তদারকি করেনি।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হয়েছে দাবি করে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বরাদ্দ দিয়েছেন। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কপোতাক্ষ খনন প্রকল্প তদারকি করার দায়িত্ব আমার নয়। প্রকল্পটি তদারকি এবং বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের। আমি জনগণের কাছে কথা দিয়েছিলাম, কথা রেখেছি।
দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় নির্বাচনেও প্রধান ইস্যু হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি। নির্বাচন আসতে না আসতেই আবারও সম্ভাব্য প্রার্থীরা কপোতাক্ষ খননের প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচিত হয়ে প্রথমে কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধতা দূর করারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। জলাবদ্ধতা নিরসন ইস্যুর সঙ্গে সম্ভাব্য প্রার্থীরা বর্তমান সাংসদের ব্যর্থতাও তুলে ধরছেন।
তারা বলেন, কপোতাক্ষ খননের জন্য চার বছর মেয়াদি ২৬২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে লবিং করে কাজ বাস্তবায়ন করা দরকার। কিন্তু বর্তমান সংসদ সদস্য তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এ কারণেই কাজ চলছে ধীরগতিতে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে এলাকার মানুষ শান্তিতে নেই। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে প্রথমে কপোতাক্ষ খননের ব্যবস্থা করবো। যে কোন মূল্যে জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৩
আরআইএম/আরআই/এসএইচ/আরকে