ঘড়িলাল, দক্ষিণ বেদকাশী (কয়রা, খুলনা) ঘুরে এসে: প্রাথমিক স্কুলে পড়তে হলে যেতে হবে পাশের গ্রামে। প্রাথমিকে উত্তীর্ণ হয়ে কেউ মাধ্যমিকে পড়তে চাইলে পাড়ি দিতে হয় পাঁচ কিলোমিটার পথ।
ভাগ্যক্রমে কারো কলেজে পড়ার সুযোগ হলে ২৫ কিলোমিটার দূরে কয়রা সদরই একমাত্র ভরসা। এ সংকটের মুখে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে মোটেও আগ্রহী নন। আর তাইতো স্কুল সময়ে বহু কোমলমতি শিশুর দেখা মেলে রাস্তায়, নদীর ধারে কিংবা চিংড়ি ঘেরে।
কয়রার সুন্দরবন লাগোয়া ইউনিয়ন উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশীর বহু গ্রামের শিক্ষাচিত্র এমনই। এসব গ্রাম থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে কলেজে ওঠা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে উঠে হয়তো প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার পথ আসা-যাওয়া সম্ভব। কিন্তু কলেজে ক্লাস করতে হলে কয়রা সদরে থেকে পড়াশোনা করতে হয়। অধিকাংশ পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানকালে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের জালিয়াখালী গ্রামে স্কুল সময়ে ভর দুপুরে কয়েকজন শিশু-কিশোরের দেখা মেলে। কেউ দোকানে আড্ডা দিচ্ছিল, কেউ খেলছিল, কেউবা মায়ের সঙ্গে নদীতে চিংড়ির পোনা ধরে এইমাত্র ফিরেছে।
স্কুলে যাওয়ার কথা আলাপ হতেই ওদের কেউ কেউ জানিয়ে দিল, স্যারেরা স্কুল ছুটি দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। পাশের গ্রাম গোলখালীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, স্কুল বন্ধ নয়। এসব ছেলে-মেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিয়েছে।
শিশু-কিশোরদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, কারো কারো স্কুলের খাতায় নাম আছে ঠিকই, কিন্তু স্কুলে নিয়মিত যায় না। আবার অনেকের নামই ওঠেনি স্কুলের খাতায়।
মাটিয়াভাঙার বেলাল হোসেনের ছেলে তাজমিনুর রহমান গোলখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। কিন্তু স্কুলে যায় না। একই অবস্থা ছালাম গাজীর ছেলে সাকিব আল হাসানের।
মাটিয়াভাঙার সিদ্দিক গাজীর ছেলে মফিজুল ইসলাম, শাহজাহান গাজীর ছেলে রকিবুল, রফিকুল ইসলাম গাজীর ছেলে বাদশা গাজী ছাড়াও অনেকেই স্কুলের খাতায় নাম ওঠাতেই পারেনি। কিশোর বয়স থেকেই নেমে পড়েছে কাজে।
একদিকে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকদের অনীহা, অন্যদিকে বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে এসব এলাকার শিক্ষা একেবারেই পিছিয়ে আছে। এসএসসি পাস করা যেন ‘অনেক বেশি শিক্ষিত’ হয়ে যাওয়া! এলাকার অভিভাবকেরা এমনটাই মনে করেন।
এ অবধি লেখাপড়া করেও আবার অনেকে বিপাকে পড়েছে। না পারছে কাজ করতে, না পারছে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে, না পাচ্ছে সম্মানজনক কোনো কাজের সুযোগ।
গোলখালী গ্রামের এইচএসসি পাস যুবক মুশফিকুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের কোচিং করাচ্ছেন। অভিভাবকেরা মিলে মাসে পাঁচ শ’ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও চার শ’র বেশি পাওয়া যায় না। পরিবারে আর্থিক টানাপড়েনের কারণে মুশফিক নিজেও লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারছে না।
গোলখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে এর জরাজীর্ণ অবস্থাও চোখে পড়ে। টয়লেট নেই, চেয়ার-টেবিল নেই, ভবনটিও বেশ পুরোনো। বর্ষায় স্কুল পানিতে ডুবে যায়। ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই তখন স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়। বিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে একজন ডিপিএড ট্রেনিংয়ে, একজন আছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন আবার অনুপস্থিত। স্কুল চালিয়ে নিচ্ছেন দুজনেই।
গোলখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শীর্ষ শিখর মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকার অধিকাংশ পরিবার সুন্দরবনের বিভিন্ন কাজের ওপর নির্ভরশীল। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানোকেই তারা বেশি লাভজনক মনে করেন। একদিকে দূরের স্কুলে গিয়ে পড়তে হয়। অন্যদিকে স্কুলে লেখাপড়ার পরিবেশও তেমন একটা ভালো নয়।
অভিভাবক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, পরিবারে আর্থিক সংকটের কারণে ছেলেমেয়েরা বেশিদূর লেখাপড়ায় এগোতে পারে না। শিশুকাল থেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের কাজে বের হতে হয়। মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা দায়িত্ব শেষ করেন। এসব কারণে অনেক ছেলেমেয়েই নিরক্ষরই থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময় ০০৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এএসআর/এসআরএস