ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের তিনবেলা খাবার যোগাড়ের কষ্ট!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৩
দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের তিনবেলা খাবার যোগাড়ের কষ্ট!

Rafiqulপারসেমারী, গাবুরা (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) ঘুরে এসে: কাজ পেলে খাবার জোটে, না পেলে আধপেটা। কেউ দু’বেলা কিংবা একবেলা খেয়েই দিন পার করে দেয়।

অনেকে ধারকর্জ করে দেনার বোঝা বাড়িয়ে চলে। কী দিয়ে এ দেনা শোধ হবে জানা নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে মানুষগুলো পড়েছে মহাসংকটে। দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষের খাবার যোগাড়ের কষ্টের দিনগুলো যেন শেষ হতে চায় না।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা আর খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী এলাকার মানুষগুলো দিনের খাবার যোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছে। এলাকা ঘুরে বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেলো তাদের জীবন চালিয়ে নেয়ার কষ্টের কথা।
DSbg
এলাকাবাসী বললেন, বছরের কোনো মৌসুমেই এদের ভালো দিন যায় না। সবুজ হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে মাঠের কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। গ্রামের মাঠে কিষান-কিষানীর ব্যস্ততার দিন এখন যেন ইতিহাস। হয়তো এলাকার বয়ো:বৃদ্ধরাই সেই সবুজের দৃশ্য মনে করতে পারবেন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত, কোনো মৌসুমের পার্থক্য বোঝেন না এলাকার অভাবী মানুষেরা। আবহাওয়ার দিক থেকেও নয়, কাজের সুযোগের দিক থেকেও নয়।

কপোতাক্ষের বুকে খেয়া পারাপারের মাঝি মোহাম্মদ আলীর যাত্রীর জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা থেকেই বোঝা যায়, এই এলাকায় খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারের কষ্ট। তিনি ভোরে বসেছিলেন কপোতাক্ষের পারে। একপারে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী, অন্যপারে শ্যাম নগরের গাবুরা ইউনিয়ন। এক-দু’জন যাত্রী হলেই ছোট্ট নৌকাটি এক পার থেকে অন্যপারে নিয়ে যান মোহাম্মদ আলী। দিনভর নৌকা চালিয়ে ৫০-৬০ কিংবা ১০০ টাকা মেলে। এ দিয়েই কোনোমতে চালিয়ে নিতে হয় সংসার। DS1

কেবল ভোরের আলো ফুটেছে। কপোতাক্ষ, শাকাড়িয়া আর খোলপেটুয়া তিন নদীর মিলিতধারা গাবুরার পারসেমারী গ্রামের মোহনায় এসে মিলেছে। একটি দোকানের সামনে জনাকয় মানুষের আড্ডা। আলাপ হতেই তারা জানালেন খাবার যোগাড়ের কষ্টের কথা। কর্মহীন মানুষগুলো কেউ ছোটো ব্যবসা করে, কেউ নৌকা চালিয়ে, কেউ চিংড়ির পোনা ধরে, কেউ সুন্দরবনে কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় অনেকে ছুটেছে ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন শহরে। শীত মৌসুম সামনে রেখে অনেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইটভাটার কাজে ছুটেছে।

পারসেমারী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আলীম বলেন, নদী আর জঙ্গল আমাদের জীবন। জঙ্গলে নিরাপত্তা নাই। জলদস্যু, বাঘ, ফরেস্ট আর কোস্টগার্ডের অত্যাচার। নদীতে পোনা ধরা নিষেধ। এই এলাকার মানুষের এক একটি দিন খুব কষ্টে কাটছে। বারবার দুর্যোগ আসে আর সব হারাই আমরা। আবার এখানেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। তারপরও গতি ফিরে পাই না।  
   
DSC2বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চললেও নাপিতখালী গ্রামে দোকানে বসা কর্মহীন মানুষেরা জানে না, দুপুরে তাদের ঘরে কী রান্না হবে। তরকারি তো দূরের কথা, একবেলার জন্য যে দেড়-দুই কেজি চাল প্রয়োজন, সেটাও ঘরে নেই। এদের দিনের রোজগার দিনেই শেষ হয়ে যায়। আর কাজ না থাকলে দোকান থেকে বাকিতে চাল নেয়া, কিংবা ধারকর্জ করে চালিয়ে নেয় একেকটি দিন।

নাপিতখালী গ্রামের সারোয়ার হোসেন। নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। সারাদিনে পেতেন ২০০-২৫০ টাকা। এখন নদীতে নামাও নিষেধ। রোজগারের পথটাও তাই বন্ধ। মাটিকাটাসহ যেখানে যে কাজ পাওয়া যায়, তাতেই কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে সংসার।

একই গ্রামের আবদুল্লাহ। কাঁকড়া ধরতে বনে যেতেন। নদীতে চিংড়ির পোনাও ধরতেন। এখন কোনোটাই নেই। বনে দস্যুদের ভয়। কাঁকড়া ধরতে গেলে ১০-১২ হাজার টাকা দিতে হয়। পারমিট থাকলে ফরেস্টারদের দিতে হয় ১০০ টাকা, পারমিট না থাকলে ২০০ টাকা। স্বাধীনভাবে আয়-রোজকার করে জীবন চালাবার কোনো সুযোগই নেই এই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষদের।

DSC3আরও কথা হলো নাপিতখালীর নূরে আলম, জাবির হোসেন, মইনুল ইসলাম, মজিবুল্লাহ, হাবিবুর রহমান, মহিউদ্দিন, আবদুস সামাদ মোড়লসহ আরও অনেক শ্রমজীবীর সঙ্গে। সবারই এক অবস্থা। এরা জানালেন, শীত মৌসুমে এলাকার মানুষের কষ্টটা আরো বেশি। এ সময় কাজের সন্ধানে বাইরে যাওয়ায় গ্রাম প্রায় লোকশুন্য থাকে। একবেলা ভাত যোগাড়ের কষ্ট কতটা তীব্র এই এলাকার মানুষ তা হাড়ে হাড়ে, ক্ষুধার কষাঘাতে টের পায়।

নাপিতখালীর পর চাঁদনিমুখা, তারপর লক্ষ্মীখালী, লেবুবুনিয়া, জালিয়াখালী--- এরকম আরও অনেক গ্রাম। মাটির রাস্তায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এই অভাবী মানুষদের অনাহার-অর্ধাহারের গল্প কানে আসে। বাইরে ঝকঝকে-তকতকে নতুন বাঁধ, আর ভেতরে কষ্টে বেঁচে থাকার তীব্র যন্ত্রণা।

ঘূর্ণিঝড় আইলার পর এখানে এসেছেন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ। সেই সুবাদে এসেছে সাহায্য। নতুন বাঁধ হয়েছে, ঘর পেয়েছে অনেকে। বসেছে পানির ট্যাংক। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সামান্যই। ক্ষুধার প্রহারে জীবন এখানে তাই গম্ভীর, নিরুৎসব বিষণ্ন। কবে তার অবসান হবে কেউ জানে না। কেউ না!       

বাংলাদেশ সময়: ০৩১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।