ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূল

অচল জীবনযাত্রা, ঝুঁকিতে খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৩
অচল জীবনযাত্রা, ঝুঁকিতে খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মরছে কপোতাক্ষ। দিনে দিনে পরিবর্তনের প্রভাবকগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে।

এরসঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি ঘেরা এ নদীর মৃত্যুঘণ্টা। কপোতাক্ষের একটি বড় অংশ মরে গিয়ে লাখো মানুষের সংকট বাড়িয়ে তুলেছে। বছরের প্রায় ছ’মাস জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন সংকট। কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়, সংকট কাটে না। কপোতাক্ষ-তীর ঘুরে এসব বিষয়ে আদিঅন্ত খোঁজ নিয়ে ‘কপোতাক্ষে বাঁচামরা’ শিরোনামে বাংলানিউজের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব

Rafiqul-islam20কপোতাক্ষ তীরের জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে এসে: কপোতাক্ষ মরে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা। আর এই জলাবদ্ধতায় ডুবছে বাড়িঘর, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা। অচল হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা, কৃষিতে নেমে আসছে চরম বিপর্যয়। ঝুঁকিতে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। শিক্ষায় অচলাবস্থা এসেছে আর যোগাযোগ সংকট ধারণ করছে প্রকট আকার।

প্রতি বছরের জলাবদ্ধতায় সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কপোতাক্ষ লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। গবেষণা সূত্র বলছে, বছরের প্রায় ছ’মাস জলাবদ্ধতা থাকায় বহু মানুষকে তাদের আশ্রয়স্থল হারাতে হচ্ছে, পড়তে হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে, কাজের সন্ধানে প্রতিটি পরিবারের মানুষজনকে অন্য এলাকায় ছুটতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর জেলার অন্তত ৫০ লাখ মানুষকে এলাকা ছাড়া হতে হবে।

অচল জনজীবন, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের কানাইদিয়া গ্রামের জিয়াউর রহমান নিজের ঘর গোছাতে গোছাতে জানালেন জলাবদ্ধতার কষ্টের কথা। বাড়ির পাশে কাঁচা রাস্তার ওপরে আশ্রয় মিলেছে তাদের। গ্রামে নিজের পাকা ঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে উঠতে হয়েছে রাস্তায়। পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঝুপড়ি বানিয়েছেন। স্ত্রী আর সন্তানদের পাঠাতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ি।
Upokul-bg2
ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার পরিবারের অবস্থা এমন। বৃষ্টিজনিত বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। কাঁচা বাড়িঘর ধসে গেছে। এবার এ এলাকায় বিভিন্ন ফসলের ভালো ফলন হলেও কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেননি কিছুই। জলাবদ্ধ এলাকার যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বাড়িগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় বহু মানুষ বাঁধের উপর কিংবা অন্যত্র উঁচু স্থানে ঠাঁই নিয়েছেন। বহু মানুষের মাটির ঘর পানির সঙ্গে মিশে গেছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, জলাবদ্ধতায় বাড়িঘর বদলাতে গিয়ে অনেককে হতে হয়েছে আশ্রয়হীন। কাজ হারিয়েছেন অনেকে। তিনবেলা খাবার যোগাড়ে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তাও চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। নারী-শিশু ও প্রবীণ ব্যক্তিদের সমস্যা সংকট সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

কৃষিতে বিপর্যয়, কৃষি-শ্রমিকেরা বেকার
হেমন্তে শীতের আগমনী মুহূর্তে এই এলাকার যে জমিতে আমনের শীষ দোল খাওয়ার কথা, যেখানে ভোরের শিশিরের ছোঁয়ায় শীতকালীন সবজি বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে থই থই পানি। বর্ষাকাল থেকে এই এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। প্রায় ছয় মাস এই পানি স্থায়ী হয়। এরমধ্যে তিনমাস খুবই খারাপ অবস্থা থাকে। কৃষি জমি মাসের পর মাস শূন্য পড়ে থাকে।

জলাবদ্ধতায় সব হারানো কপোতাক্ষতীরের মানুষগুলো ফসলি জমির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় এলাকা ডুবে যাওয়ার কারণে এককালের কৃষকেরা দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছে ফসল আবাদের অভ্যাস। আগে বিভিন্ন প্রজাতির ধানের ওপর এলাকার মানুষ নির্ভরশীল হলেও এখন জমিতে কোনো ফসল হয় না। কৃষি-শ্রমিকেরা কাজের সন্ধানে ছুটেছেন অন্যত্র।

সাতক্ষীরার তালার গঙ্গারামপুরে পিচঢালা সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকানে দেখা মেলে এমনই কিছু বেকার কৃষি-শ্রমিকের। এমন একজন আসাদুল গাজী। বাড়ি গঙ্গারামপুর গ্রামে। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন বেকার। প্রায় তিন মাস ধরে হাতে কাজ নেই। দোকান থেকে বাকিতে মালামাল নিয়ে দেনা হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। ইরি মৌসুমে ঘরে মজুত চাল দিয়ে কোনোমতে আটজনের সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন বেকার কৃষি-মজুরের সংখ্যা এলাকায় অনেক।
Upokul-120
শিক্ষায় অচলাবস্থা
জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকা গ্রামের বাড়িঘর থেকে অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসছে। কখনো হাঁটু কিংবা কোমর সমান পানি, কখনো কাদা, আবার কখনো নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয় স্কুলে। কোনো স্কুলের মাঠে কোমর পানি, কোনো কোনোটির শ্রেণীকক্ষই ডুবে আছে পানিতে। বেশ কয়েকটি স্কুলের ক্লাস চালানো হচ্ছে স্কুলের ভেতরে মাচা বানিয়ে, পাশের কোনো বাড়িতে, মক্তবে, মন্দিরে কিংবা স্কুলের পাশের কোনো উঁচু স্থানে। এমনই সব চিত্র চোখে পড়ে সাতক্ষীরার জলাবদ্ধ এলাকাগুলোতে।

এরফলে জলাবদ্ধ এলাকার শিক্ষায় অচলাবস্থা নেমে এসেছে। অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে তালা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, কিছু স্কুলে পানি উঠেছে। তবে কোথাও ক্লাস বন্ধ করা হয়নি। যেখানে যেভাবে সম্ভব ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সড়কের ক্ষতি, যোগাযোগ সংকট
জলাবদ্ধ এলাকা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার অনেক সড়কের অবস্থা এমনই। দীর্ঘদিন পানিতে ডুবে থাকায় সড়কে ছোট খাদগুলো বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। কোথাওবা সড়ক ভেঙে এপাশ ওপাশ করছে পানি। যানবাহন চলাচলের জন্য স্থানীয়ভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে লাগছে সামান্যই। সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন তালা-পাইকগাছা সড়কসহ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের এগারোটি সড়কের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। জলাবদ্ধতার সময় এখানকার অনেক সড়ক কার্যত বন্ধ থাকে।

তালা উপজেলা প্রকৌশলী বাদল চন্দ্র কির্ত্তনীয়া বাংলানিউজকে বলেন, ডুবে যাওয়া রাস্তাগুলো উঁচুকরণের কাজ চলছে নিয়মিতভাবে। এইসব রাস্তা প্রতিবছরই এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করা হচ্ছে। তারপরও পানিতে ডুবছে।

রাজনীতির ইস্যু জলাবদ্ধতা
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কপোতাক্ষ তীরবর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি এখন রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিগত নির্বাচনের আগের সময়ের সঙ্গে জলাবদ্ধ এলাকার বর্তমান অবস্থার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পাঁচ বছরেও তালা-কলারোয়া আসনের সংসদ সদস্যের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর অধিকাংশই ক্ষুব্ধ।

খলিলনগর ইউনিয়নের পাকারমাথা এলাকার রবিউল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য কপোতাক্ষ খননের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তার মেয়াদ শেষ হলেও খনন হয়নি। আমাদের দুর্ভোগ রাজনীতির ইস্যু।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।