শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): আমাদের বাড়ির আশপাশেই এই ক্ষুদ্র পাখির অবস্থান। কিন্তু আমরা জানি না! আমাদের ফলদগাছগুলোর পাতায় পাতায় এখন পোকার অনুসন্ধানে মহাব্যস্ত পাঁচ গ্রাম বা এর কাছাকাছি ওজনের এসব পরিযায়ী ছোট পাখিরা।
পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোর তীব্র শীতের দুর্বিষহ দাপট থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বস্ত ডানায় ভর করে এ সব পাখি আমাদের দেশসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রতি বছর পাঁচ-ছয় মাসের জন্যে চলে আসে। এভাবেই চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এমন পাখিদের ‘পরিযায়ী পাখি’ (Migratory Bird) বলা হয়।
Grey-headed Canary-Flycatcher
পাঁচ গ্রাম ওজনের ক্ষুদ্র এ পাখির নাম ‘হলদেভ্রু-ফুটকি’ (Inornate Warbler)। দৈর্ঘ্যে ১০ সেমি। আমাদের চড়ুইয়ের চেয়েও ছোট। জলপাই-সবুজ পিঠ এবং সাদাটে পেট তার। শুধু তা-ই নয়, ‘টিকেলের-পাতাফুটকি’ (Tickell’s Leaf-warber), মেটেমাথা-ক্যানারিচুটকি (Grey-headed Canary-Flycatcher) প্রভৃতি ‘ফুটকি’ (Warber) এবং ‘চুটকি’ (Flycatcher) পরিবারের বিভিন্ন পরিযায়ী ছোট-ছোট পাখিরা এখন আমাদের দেশের প্রকৃতিতে মিশে রয়েছে। খুব ছোট বলেই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় এরা।
প্রতিবছর শীতমৌসুমে বাইক্কাবিলের ঢোলকলমির বনে এমন ছোট ছোট পরিযায়ীদের হাঁকডাক আর দৌড়ঝাঁপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যায় না। শরীরজুড়ে গভীর চঞ্চলতা তাদের। একটুও বিশ্রামের সময় নেই! স্নিগ্ধ সকাল, ক্লান্ত দুপুর কিংবা আলো নিভে আসা বিকেলের প্রতিটি মুহূর্তই ফুটকি-চুটকি মায়াবী কণ্ঠস্বরে স্বর্গীয় হয়ে উঠে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, হিমালয় পর্বত হয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ছোট ছোট পরিযায়ী পাখিরা এখন বাংলাদেশে চলে এসেছে। আমাদের বাড়ির আশপাশের আম-জাম প্রভৃতি গাছেই রয়েছে সে। আমাদের টুনটুনির চেয়েও ছোট তারা।
‘ওর গায়ের রং পাতার রঙের মতোই। হলুদে সবুজে মেশানো। ওরা গাছের পাতায় পাতায় পোকা খুঁজে বেড়ায়। ওর জন্য দিনে দু-তিনটে পোকাই যথেষ্ট। কিন্তু ও আবার ডিম পাড়বে একেবারে সাইবেরিয়ার তুদ্রা অঞ্চলে গিয়ে। ’
পরিযায়ীর সংখ্যা উল্লেখ করে ইনাম আল হক বলেন, আমাদের সাড়ে ৩০০ পরিযায়ী পাখির মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখিই কিন্তু ছোট আকারের। সহজে তাদের দেখা যায় না। ছোট পাখিদের আমাদের দেশে আসতে একমাসের মতো সময় লেগেছে। কারণ ছোটপাখি একনাগাড়ে উড়ে আকাশ দিয়ে চলে আসে না। ঝোপ থেকে ঝোপে, গাছ থেকে গাছে তারা বিরতি নিয়ে নিয়ে উড়ে উড়ে আসে।
যে সব পাখি পরিযাজন করে আমাদের দেশে আসে তার মধ্যে ছোট পাখির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ৫ গ্রাম ওজনের পাখি অর্থাৎ, একটি দেড়কেজির হাঁসকে ৩০০ টুকরো করলে একেকটি টুকরোর সমান ক্ষুদ্র বলে আমাদের চোখে ওরা ধরা পড়ে না। একেকটি লোকালয়ে এমন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী ছোট পাখি রয়েছে। আর এদের কারণেই আমাদের গাছের পাতাগুলো ক্ষতিকর পোকার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। জানান এ পাখি গবেষক।
তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বাইক্কা বিলে ‘বার্ড রিংগিং’য়ের (পাখির পায়ে রিং পরানো) সময় একবার হাতে পেলাম ‘হলদেভ্রু-ফুটকি’ (Inornate Warbler) নামক মাত্র পাঁচ গ্রামের ছোট্ট পাখিটিকে। এটি আমাদের টুনটুনির চেয়েও ছোট। সাইবেরিয়া থেকে যাত্রা শুরুর সময় সম্ভবত এর ওজন ছিলো ৭ গ্রাম। যাত্রাপথে এর ছোট দুটো ডানায় শক্তি জোগাতে গিয়ে ক্ষয় হয়েছে মাত্র ২ গ্রাম। সত্যিই অবাক কাণ্ড!’
আমাদের হাওর-বিলের ঝোপঝাড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাইবেরিয়ায় জন্ম নেওয়া ফুটকি, চুটকি ও দামা পরিবারের অগণিত পরিযায়ী পাখির জীবন-কাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের ঢোলকলমির ঝোপঝাড়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কথাটি কিন্তু অনেকেই জানেন না। হাওর-বিল এলাকার ওই ঢোলকলমির ঝোপঝাড়গুলো কেটে ফেলা মানে ছোট ছোট এ পরিযায়ী পাখিদের জীবন বিপন্ন করে তোলা।
আমার বিশ্বাস – এ পাখির এরূপ জীবন-কাহিনীর কথা পড়ে কেউ হয়তো আর হাওর-বিলের এসব ঢোলকলমিকে আর অবহেলার চোখে দেখবে না। প্রত্যাশা করেন এ পাখি বিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৬
বিবিবি/এএ