চারিদিকে মাঠে মাঠে ফসলের উল্লাস। সংগ্রাম শেষে ধান পাওয়ার আনন্দ কৃষকের চোখে-মুখে।
নোওয়াবাইদ গ্রামের তিতু মিয়ার হাত দ্রুত চলছে কাঁচা পাট সংগ্রহের কাজে। পাশের ডোবা মতো জলাশয় থেকে ভেজা, নরম পাট গাছ এনে রাখা হচ্ছে বাড়ির সামনের উঠোনে। তিতু মিয়া কয়েক জনকে নিয়ে ছাড়াচ্ছেন পাটের আঁশ। রোদে শুকিয়ে বাজারে নেওয়া হবে সে পাট। পাটের মৌসুমে আঙিনার এখানে সেখানে পাটের স্তূপ আর পচা পচা এক ধরনের গন্ধ মৌতাত করছে সর্বত্র।
‘পাট তোলার পর পরই ধান উঠবে’, তিতু মিয়া খুশি। তার চোখ বার বার চলে যায় ফসলের মাঠে। বড় আনন্দ আর স্বস্তিতে তিনি দেখেন রোপিত শস্যের বেড়ে ওঠা। গ্রাম ভর্তি উদোম গায়ের শিশুর দল। শরীরে পোশাক নেই, পায়ে নেই জামা। তবু তারা কত খুশি। ফসল আসবে, এই খুশি যেন ছড়িয়ে গেছে অবোধ শিশুদের মনেও।
হাট-বাজারে কথা বলে জানা গেছে, ধান-চালের দাম স্থিতিশীল। ‘পাইকার ও মজুতদার আস্তে আস্তে সব জমানো চাল ছেড়ে দিচ্ছে। সামনেই নতুন ধান উঠবে, তখন দাম আরো কমবে’, বললেন কিরাটন বাজারের আশরাফ আলী। ‘আল্লাহর রহমতে এইবার ফসল ভালো। ’ দোকানির মুখে খুশির আভা।
গ্রাম্য হাট-বাজারে চাষিরাও এসেছেন এখন পাট নিয়ে। কেউ সাইকেলে, কেউ রিকশায়, কেউ মাথায় চাপিয়ে পাট নিয়ে এসেছেন। বড় বড় পাইকার সে পাট কিনে নিয়ে যাবে। ভৈরব হয়ে সেগুলো যাবে আরো বড় আড়তে। তাড়াইল বাজার ঘাটে পণ্যবাহী ট্রলার ধরনের বেশ কিছু দেশি নৌযান অপেক্ষা করছে পাট বোঝাই করে দূরের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য।
বাজারে দেখা গেল, ধানের চারার ছড়াছড়ি। বীজতলা বানানোর জন্য চারাগাছ কিনে নেবেন চাষিরা। ছোট্ট এক চিলতে জমিতে আপাতত লাগিয়ে রাখবেন সেগুলো। যত্ন করে ধরে রাখবেন কিছুদিন। ফসল কাটা হলেই বপন করা হবে সে চারা। ফসলের শিল্পী কৃষকের যেন বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য আজো নিরন্তর প্রচেষ্টারত বাংলার হাসিমুখ কৃষক।
বাজারগুলো সয়লাব হয়েছে শুকনো মাছে। বর্ষা শেষে ধরা পড়েছিল প্রচুর মাছ। সেগুলো সব খেয়ে ফেলা সম্ভব হয় নি। বাড়িতে বাড়িতে নিজস্ব পদ্ধতিতে মাছ শুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিছুটা নিজেরা খেয়েছেন। ঠেকার সময় কিছু বিক্রি করছেন। তালজাঙ্গা বাজারে সারি সারি পুঁটি, টেংরা, চাপিলা, কাকিলা, শোল, চান্দার শুটকি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শুষ্ক মাছের আঁশটে গন্ধে ভরে আছে সারা বাজার। হাটুরেদের কেউ কেউ খানিক মাছ আর কিছু তরকারি নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন।
পরিবর্তন বা বদলে যাওয়া সময়ের দাবি হলেও ভুল বা অপরিকল্পিত অদল-বদল ক্ষতিকর। গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেললেই উন্নতি হবে না, তাকে বানাতে হবে আধুনিক সুবিধায় পরিপূর্ণ গ্রাম। শস্য উৎপাদন, গ্রামীণ শিল্প, সংস্কৃতি, খাদ্যগুলো বদলিয়ে দেওয়া ভুল হবে। এগুলোকে সংরক্ষণ আর উন্নততর করতে হবে। বাংলাদেশের মূল সত্তা গ্রাম নষ্ট হলে বিরাট বিপদই নেমে আসবে। গ্রাম সমৃদ্ধ হলেই সবার কল্যাণ হবে।
বদলে যাওয়া গ্রামের চালচিত্রে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক সামগ্রী। চেনা ভূগোল, নদী, খাল, ভূমিরূপ, খাবার-দাবার, পোশাক, গান-বাজনা ধীরে ধীরে হারাচ্ছে। লুপ্ত হচ্ছে লোকসংস্কৃতি ও চিরায়ত গ্রামীণ জীবন।
কিন্তু শত পরিবর্তনেও হারাচ্ছে না ফসলের মাঠ, মাঠের দিগন্ত বিস্তৃত দোলা আর সংগ্রামী কৃষকের হাসি। সংগ্রামী কৃষকরাই শত কষ্ট সহ্য করে হাসিতে আনন্দে গ্রামগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে; বাংলাদেশকে প্রাণপ্রবাহে ভরিয়ে দেবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৭
এমপি/জেডএম