অতিথি পাখিদের আরেক বড় আবাসস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান ফিজু বাংলানিউজকে জানান, ক্যাম্পাসে কিছু কিছু পাখি এসে গেছে। অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ টিলা আর বনানীময় ক্যাম্পাসেও প্রতি বছর কিছু অতিথি পাখি আসে। প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. গাজি আসমত বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে এখনো সেভাবে পাখি আসে নি। তবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মীরসরাইয়ের অল্প উচ্চতার পাহাড়ি জঙ্গলে কিছু পাখি দেখা গেছে। ’
বাংলানিউজের প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অতিথি পাখিদের আগমনের খবর জানাচ্ছেন। বড়ই বিচিত্র এসব অতিথি পাখি। প্রকৃতির অপরূপ সদস্য যেন একেকটি পাখি। বাংলাদেশের শীতকালকে অনেক রঙিন আর মোহনীয় করে দূরান্ত থেকে আগত নানা প্রজাতির এসব অতিথি পাখির দল।
তীব্র শীতে একটু উষ্ণতা, আশ্রয় ও খাদ্যের সন্ধানে ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাতসহ প্রকৃতির শত প্রতিকূলতা মাড়িয়ে অতিথি পাখির দল পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূরের দক্ষিণের দেশগুলোতে। নদী মার্তৃক বাংলাদেশ অতিথি পাখিদের তেমনই একটি পছন্দের আবাসস্থল।
দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে বর্তমানে যে ২ হাজার ১০০ প্রজাতির পাখি আছে, তার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩শ' প্রজাতির পাখিই অতিথি, যারা প্রতি বছর শীতের সময়টুকু হিমালয় পেরিয়ে চলে আসে। বুকের পালকে ওম নিয়ে কাটায় শীতের দিনগুলো। তারপর ফিরে যায় স্বদেশের প্রিয় প্রাঙ্গণে। ঝরা পালকের স্মৃতিচিহ্ণ ধরে পরের বছর আবার চলে আসে পাখিগুলো।
সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে দলবেঁধে আসে এসব পাখি, থাকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি এ দু' মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে। বাতাসে শীতের আমেজ লাগতেই বাংলাদেশের হাওর, বিল, চরাঞ্চলে দেখা যায় হাজার হাজার অতিথি পাখি। ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ার, সাইবেরিয়া কিংবা এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে বাঁচতে এরা পাড়ি জমায় সমুদ্রবর্তী দক্ষিণের কম শীতের দেশে।
পক্ষী বিজ্ঞানিরা জানান, প্রকৃতিগতভাবেই এ পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত। এরা সাধারণত ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়ে যায়। ছোট পাখিদের ঘণ্টায় গতি ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমটার উড়তে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে। একা নয়, দীর্ঘ পরিভ্রমণের পথে তারা চলে দলবদ্ধভাবে।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এক আশ্চর্যের বিষয়; অতিথি পাখি তাদের গন্তব্যস্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে নিজস্ব ইন্দ্রিয় শক্তির সাহায্যে। । বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পাখির রয়েছে বংশগত সূত্রে পাওয়া বিশেষ দিক-নির্ণায়ক ক্ষমতা। শীত মওসুমে এদেশে আসা পাখিরা কেউই স্থানীয় নয়। সবাই বাইরে থেকে আসে এবং চলেও যায়। এসব পাখি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থেকে যায় না।
বাংলাদেশে আগত অতিথি পাখিদের মধ্যে সোনাজঙ্গ, খুরুলে, কুনচুষী, বাতারণ, শাবাজ, জলপিপি, ল্যাঞ্জা, রাজহাঁস, বালিহাঁস, হরিয়াল, দুর্গা, টুনটুনি, রাজশকুন, লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু, জঙ্গী বটের, ধূসর বটের, হলদে খঞ্চনা, কুলাউ ইত্যাদি প্রধান। গ্রীষ্মকালে সুমেরুতে বাস করে এবং বাচ্চা দেয়, হাঁস জাতীয় এমন পাখি শীতকালে বাংলাদেশে আসে। লাল বুকের ক্লাইক্যাসার পাখি আসে ইউরোপ থেকে। আর অন্য সব পাখিরা আসে পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে।
মওসুমী অতিথি পাখির কলরব আর গুঞ্জনে দেশের বিশেষ কয়েকটি স্থান মুখরিত হয়ে উঠে। এর মধ্যে বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মীরপুর চিড়িয়াখানা, চলনবিল, সুন্দরবনের কোনও কোনও স্থান, বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এসব অতিথি পাখিদের প্রিয় অবকাশ কেন্দ্র। বাংলাদেশের জলাশয়গুলোই যেন এদের পছন্দের স্থান ও নিরাপদ আশ্রয়। বেশ কয়েক বছর যাবত নিঝুম দ্বীপ, দুবলার, চরকুতুবদিয়া এলাকাতেও শীতের পাখিরা বসতি গড়েছে বলে পযবেক্ষকরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে প্রায় ২০-২৫ প্রজাতির অতিথি পাখিতে জমজমাট হয় শীতকাল। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পাখি হচ্ছে জেন্ডাসিগলা। জাডানিক বা সরালী হাঁস। দলবেঁধে শিস দিয়ে গান গেয়ে উড়ে যায় এরা। কালচে বড় লম্বা গলার এ সরালী পাখিকে দেখলে অনেকটা দেশী হাঁসের মতো মনে হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এ পাখিগুলো দিনের বেলা লেকের বা জলাশয়ের পানিতে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। রাতে খাবারের সন্ধানে অন্য জায়গায় চলে যায়। সাধারণত দিনের মিষ্টি রোদে থাকতে এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
অজানার পথে মায়াবী ডানায় ভর করে অন্য দিগন্ত থেকে উড়ে আসা ক’দিনের এই অতিথি পাখিদের পেয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতিও উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল রূপ ধারণ করে। উষ্ণতা, খাদ্য আর আশ্রয়ের সন্ধানে আসা এই অতিথিরা যেন দোসর হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে ফিরে না যায়। আনন্দে-উল্লাসে বার বার যেন ফিরে আসে তাদের দ্বিতীয় স্বদেশ বাংলাদেশে। আতিথ্য ও সাদর বরণে তৃপ্ত হয় এদেশে। ঘাতক ও শিকারের কবলে প্রাণ না হারায়।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৭
এমপি/জেডএম