অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু জেলে নদী-খালে মাছ ধরতে গিয়ে প্রায় সব জলজ প্রাণী মেরে ফেলছেন। কারণ জাল দিয়ে মাছ ধরার বদলে বিষ প্রয়োগ করছেন তারা।
যদিও বনবিভাগ ও কোস্টগার্ড মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বিষের বোতল ও বিষ দিয়ে ধরা মাছসহ জেলেদের আটক করে। পুড়িয়ে দেয় জাল। গত ১৫ দিনে দুই দফার অভিযানে ১৫ জেলেকে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে বিষ মিশ্রিত মাছ, জাল ও নৌকা।
তবে অভিযোগ রয়েছে, জেলেদের কোনো সাজা না দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়া অনেক সময় সুন্দরবনের ডাকাত, বনবিভাগ, রাজনৈতিক নেতা আর মহাজন নামক দাদন ব্যবসায়ীদের প্রভাবের কারণে জেলেরা খুব সহজে বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে। এ কারণে কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার।
সবশেষ রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের ঝনঝনিয়া খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের অপরাধে ১২ জেলেকে আটক করেছে কোস্টগার্ড সদস্যরা। অভিযানে আটকদের সঙ্গে থাকা ছয়টি মাছধরা নৌকা, ১২ হাজার মিটার চরঘেরা জাল, ৮শ’ কেজি বিষযুক্ত চিংড়ি এবং চার লিটার বিষ জব্দ করা হয়।
এর আগে শনিবার (২৫ আগস্ট) সকালে বনের শ্যালা নদীর হরিণটানা এলাকায় বিষ (কীটনাশক) দিয়ে মাছ শিকারের সময় শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের আলতাফ হোসেন (২৫), জামাল হাওলাদার (২৭) ও আলাউদ্দিন হাওলাদারকে (৩০) আটক করে বনবিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে এক বোতল কীটনাশক, ১০ কেজি বিষ মিশ্রিত মাছ, একটি জাল ও একটি নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
কয়েকজন জেলে জানান, সুন্দরবন এলাকার নদী ও খালগুলোতে বেন্দি, কারেন্ট, বুনো ও নেট জাল দিয়ে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করছে সরকার। মাছ ধরতে গেলেই প্রায় নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, বনবিভাগের লোকজন তাদের বাধা দেয়। বিষ প্রয়োগ না করলেও অনেক সময় জাল নিয়ে যায়, নৌকা আটকিয়ে রাখে।
সুন্দরবনের জয়মনির ঠোটার জেলেপল্লির জেলে হাবিব বলেন, মাছ, চিংড়ির পোনা, কাড়া (কাঁকড়া) ধরে খাই। পোনা ধরতে দেয় না। কোস্টগার্ড বনবিভাগ ধাবড়ায়, জাল নিয়ে যায়। জাল লইয়ে পুড়ায়ে দেয়।
জানা যায়, সুন্দরবনের নদী-খালে কীটনাশক (বিষ) প্রয়োগ করে অবাধে মাছ শিকার করছেন একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। এতে ধ্বংস হচ্ছে লাখ লাখ রেণু পোনা।
আশঙ্কাজনকভাবে মাছের বংশবিস্তার নষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবনের ঝনঝনিয়া খাল, শ্যালা নদীর হরিণটানা এলাকা, সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের ঝাপসি, ভদ্রা, হাডড়া, চাইলোবগী, নিষেনখালী, সাহেবখালী, বোটবুড়নিয়া, পাটকোষ্টা, হংশরাজ, পাঠাকাঠা, ভোমরখালী, আইড়ো শিবসাসহ বিভিন্ন স্থানে বিষপ্রয়োগে মাছ ধরেন জেলেরা। এসব এলাকার মধ্যে বেশকিছু নদী ও খাল অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে প্রজনননের কারণে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বনবিভাগ থেকে মাছ শিকারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বনের অভ্যন্তরের বেশ কিছু নদ-নদী ও খালকে। সুন্দরবন বিভাগ সূত্র জানায়, পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ মিলিয়ে পুরো সুন্দরবনের অভ্যন্তরে থাকা মোট চারটি রেঞ্জের আওতাধীন ১৮টি খালে সব ধরনের জেলে প্রবেশ ও মাছ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মাছ শিকারের জন্য বন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বাগেরহাটের মোংলা, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগরসহ সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় কীটনাশকের যেকোনো দোকানে গেলেই পাওয়া যাচ্ছে মাছ শিকারের বিষ। এসব বিষ কিনে জেলেরা নদীতে প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছে।
হারবারিয়া ফরেস্ট স্টেশনের এক বনরক্ষী বলেন, পর্যাপ্ত অস্ত্র, জলযান ও জনবলের অভাব, সোর্স মানি ও ঝুঁকি ভাতা না থাকায় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারণ্যে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার কোনভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না।
পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোটের খুলনার সদস্য সচিব এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, ফসলের পোকা দমনে ব্যবহৃত বিষসহ বিভিন্ন কীটনাশক মাছ শিকারে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে সুন্দরবনের মৎস্য ভাণ্ডার এখন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, অসাধু জেলেরা বন বিভাগের সহায়তায় সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালগুলো থেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট (বিএনভিআর-গোয়েন্দা কর্মকর্তা) আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে জেলের একটা ভালো জাল ছিলো যা নিষিদ্ধ। সেটা কোস্টগার্ড দিয়ে গেছে। পরে জেলে জীবন জীবিকার তাগিদে বিষ দিয়ে মাছ শিকার শুরু করে।
তিনি জানান, মানবিক কারণে অনেক সময় অসহায় দরিদ্র জেলেদের ছেড়ে দেওয়া হয়। রোববারও যে ১২ জনকে আটক করা হয়েছে তাদের সতর্ক করে নাম ঠিকানা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমবার ছেড়ে দেওয়ার পর যদি আবার কেউ আসে তাদের আগের নাম ঠিকানার সাথে মিলে গেলে সাজা দেওয়া হয়।
আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দাবি করেন, সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ডের পেট্রল টিম থাকায় অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের ঘটনা খুবই কম।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের নদী ও খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার প্রতিরোধে সব সময় চারটি টিম কাজ করে। বিষ দিয়ে সর্বনাশা মৎস্য শিকার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে বনবিভাগ।
বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় হাতেনাতে আটকের পর কোস্টগার্ড জেলেদের ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে মাহমুদুল হাসান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। দরিদ্র হওয়ার কারণে মানবিক বিবেচনায় ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমার জানা থাকলে আটকদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা হতো।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮
এমআরএম/এমজেএফ