বিন্দু বিন্দু দানাদার ফুলগুলোতে সুক্ষ্ম কীটপতঙ্গ ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে ভেতরে এসে পরাগায়ন ঘটায়। তাতেই শোভা পায় ফলের ভেতরের এই ফুল।
বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ডুমুর। এক সময় বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশে এই উদ্ভিদটি পাওয়া গেলেও বর্তমানে এরা বিপন্ন। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যত প্রজাতির ডুমুর রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো যজ্ঞ ডুমুর বা জাগ ডুমুর। প্রকৃতির কোলে ধরেছে বিপন্ন ‘যজ্ঞ ডুমুর’।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও উদ্ভিদ গবেষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এই ডুমুরটি নাম যজ্ঞ ডুমুর। তবে বাংলায় তাকে জগ ডুমুরও বলে। এর ইংরেজি নাম Cluster Fig এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Ficus Racemosa. প্রাকৃতিকভাবে এই Ficus গ্রুপের (বট-অশ্বত্থ জাতীয়) উদ্ভিদের নাম ‘জঙ্গল-বার্গার’।
উদ্ভিদটির বর্ণনায় আরও বলেন, যজ্ঞ ডুমুর উদ্ভিদটি বিশ থেকে ত্রিশ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পত্রঝরা বৃক্ষ। পাতায় নয়, এ গাছের পুরু কাণ্ডজুড়ে ফল ধরে থাকে। আগে তো আমাদের গ্রাম-বাংলায় এই উদ্ভিদটিকে পাওয়া যেত। এখন এর সংখ্যা কমে গেছে। তবে ফরেস্টে (বনে) যে মাত্রায় থাকার কথা ছিল সে অনুযায়ী এই উদ্ভিদটি নেই। কিন্তু গ্রাম-বাংলায় এখনো টুকটাক খুঁজে পাবেন। সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণীর খাবার জোগান দেয়। বায়োডায়ভারসিটি (জীববৈচিত্র্য) রক্ষা করতে গেলে বন-জঙ্গলে এই ডুমুর গাছ লাগবেই। এটা ছাড়া বায়োডায়ভারসিটি রক্ষা করা যাবে না। তবে এ যজ্ঞ-ডুমুর মানুষও খেয়ে থাকে। এটিতে সুগারের পরিমাণ কম, উন্নত সবজি। তাই যারা ডায়াবেটিক রোগী তারা এই ফলটি খেলে উপকার লাভ করবেন। সবজি আকারে রান্না করে খাওয়া যায়। কিছুটা মিষ্টি ধরনের।
প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনায় এ উদ্ভিদের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি জানান, এই যজ্ঞ-ডুমুর বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ। কারণ, ফরেস্ট-ম্যানেজমেন্টের (বন-ব্যবস্থাপনা) সময় এই প্রয়োজনীয় উদ্ভিদগুলোকে রাখা হয়নি। ফরেস্ট ম্যানেজ করা হয়েছে মূল্যবান টিম্বারের (কাঠ) জন্য। এই উদ্ভিদের যেহেতু টিম্বার ভ্যালু (গুরুত্ব) নেই, তাই ম্যানেজমেন্টের তালিকায় ছিল না। ফলে টিম্বার ম্যানেজ করার সময় এই দেশের বনাঞ্চল থেকে উদ্ভিদগুলো কাটা পড়ে যায়।
১৯৯২ সালের পরে যখন বায়োডায়াভারসিটি (জীববৈচিত্র্য) এবং ওয়াইল্ড-লাইফ (বন্যপ্রাণী) কনসেপ্ট (ধারণা) আসলো তখন উৎকণ্ঠা দেখা দিল যে- বন্যপ্রাণীরা খাবে কী? তখন উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- বনের ফলের গাছগুলো আর কাটা যাবে না। তখন থেকেই এই প্রজাতির গাছগুলোকে গুরুত্বসহকারে সাধারণ বনসহ সংরক্ষিত চির সবুজ বনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
ড. জসীম উদ্দিন এ উদ্ভিদটির প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন, পানির কাছাকাছি বা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় এই গাছটা হলে এই গাছের গোড়াটা ‘বাথট্রেস’ (বড় শিমুলগাছের গোড়ার মতো কয়েকটা ভাগে ভাগ হয়ে উঁচু-নিচুভাবে ছড়িয়ে পড়া) হয়ে যায়; গাছটাকে ব্যালেন্স (ভারসাম্য) ঠিক রাখার জন্য। গাছের উপরের ওজনের সঙ্গে নিচের রুট যদি ছড়ানো না হয় তখন গাছটি পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে; তাই তার রক্ষার জন্য এমন প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা অর্থাৎ, বাথট্রেস হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার গাছ; চীন, ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউ গায়না ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। জঙ্গল বা বনভূমির একটু স্যাঁতস্যাতে জায়গায় এটা জন্মায়। পাহাড়ি ছড়া, নালা বা প্রাকৃতিক জলাধারের পাশে এরা বেশি জন্মায়।
‘বটও আবার কিন্তু ডুমুর জাতীয় উদ্ভিদ। কারণ এর ফুলও দেখা যায় না। ডুমুরের ফুল যে রকম ভিতরে থাকে বটেরও তাই। ফলগুলো গোড়ায় একটা খুব সরু ছিদ্র থাকে, ইনসেক্ট (কীট, পিঁপড়া) এর মাধ্যমে এই ছিদ্র দিয়ে গিয়ে পলিনেশন (পরাগায়ন) হয়। এই ফলের ভিতরে মেল (পুরুষ) এবং ফিমেইল (নারী) ফুল রয়েছে; পিঁপড়াসহ নানা জাতীয় ক্ষুদ্র পোকা-মাকড় সেই সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ফলে ফলে ঘুরে বেরিয়ে পরাগায়ন ঘটায়। ’
এই উদ্ভিদ জন্মাতে বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়। পাখি বা বন্যপ্রাণীর মলদ্বারা নির্গত হওয়া বীজটি মাটিতে পড়ে সফল বৃক্ষে রূপান্তরিক হয়। অর্থাৎ এই ডুমুরকে পশুপাখিরা যখন খায় এবং পরে যখন তাদের মল বা বিষ্ঠা দ্বারা সেই ফলের বীজ যখন বের হয়ে মাটিতে পড়ে তখন তার থেকে জার্মিনেশন (অঙ্কুরোধগমযোগ্য) হয়। এমনিতে ফলটি মাটিতে পড়ে জার্মিনেশন হওয়াটা খুবই টাফ (কঠিন)। তখন জার্মিনেশনের জন্য তাপমাত্রা, আর্দ্রতা প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। এই ফলটি পশুপাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে খুব সহজেই ছাড়ায় বলে জানান উদ্ভিদ গবেষক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৯
বিবিবি/এএ