পদ্মার চরে প্রথমবারের মতো জলচর পাখিশুমারি করেছেন একদল গবেষক। ওই শুমারি চলকালে তারাও এ পাখিটির সন্ধান পান।
চোখ, পা ও পায়ের পাতা লাল এবং উজ্জ্বল লাল-কমলা রঙের হাঁস প্রজাতির ‘কমন মার্গেঞ্জার’ পাখির বৈজ্ঞানিক নাম ‘মার্গার মার্গেঞ্জার’। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে একে ‘পাতি মার্গেঞ্জার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে- পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর এ হাঁসকে রাজশাহীর পদ্মায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে।
ওই শুমারিতে বিরল প্রজাতির ‘বৈকাল তিলিহাঁস’ পাখিরও দেখা মিলেছে। শুধু তাই নই, পাখির চলাচলের পথ ও আচরণ সম্পর্কে জানতে প্রথমবারের মতো দূর পরিযায়ী এক পাখির পিঠে বসানো হয়েছে অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র (জিপিএস ট্র্যাকার)।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) রোববার (৫ জানুয়ারি) রাজশাহীর পদ্মা নদীর ৩৯ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ পাখিশুমারি করে। আইইউসিএন বাংলাদেশের ওয়াইন্ড বার্ড মনিটরিং প্রোগ্রামের আওতায় করা এ শুমারিতে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, রাজশাহী বার্ড ক্লাব এবং বন অধিদপ্তর। ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী দুর্লভ পাখির যেসব তথ্য প্রকাশ করে সেখানে রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের এ পাখিশুমারির তথ্যচিত্র পাঠানো হবে।
আইইউসিএন বাংলাদেশের তথ্য মতে, শুমারিতে পদ্মার পাড়জুড়ে ৩৭ প্রজাতির মোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করা হয়। এরমধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১০০টি পাওয়া গেছে পিয়ং হাঁস। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিং এর চা পাখি। সবচেয়ে বিরল পাখির মধ্যে দেখা গেছে একটি বৈকাল তিলিহাঁস। এছাড়া দেশি মেটে হাঁস, লালমাথা ভূতিহাঁস, ইউরেশিয় সিথিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, কালা মানিকজোড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
আইইউসিএন-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, পদ্মার চরে অনেক দুর্লভ প্রজাতির পাখি পাওয়া যাচ্ছে। এ বছরই পদ্মাচরে প্রথম দেখা গেছে ‘কমন মার্গেঞ্জার’।
বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ও গবেষক অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান পদ্মার পাড়ে এ পাখিটির দেখা পান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘কমন মার্গেঞ্জার’ পাখি বাংলাদেশে অনিয়মিত। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি। এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও ভুটানে দেখা যায়। সাম্প্রতিককালে এটিকে তৃতীয়বারের মতো দেখা গেল। এর আগে দু’বার উত্তরের বিভাগ রংপুরের ঠাকুরগাঁওয়ে দেখা গেছে।
এর বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে তিনি বলেন, মার্গেঞ্জার প্রবহমান নদী ও নালায় বিচরণ করে। স্রোতের বিপরীতে পানির নিচে ডুব দিয়ে মাছ ধরে খায়। এর খাদ্যতালিকায় মাছ ছাড়াও রয়েছে জলজ পোকামাকড়, চিংড়ি, শামুকজাতীয় প্রাণী, ব্যাঙ, পাখি, খুদে স্তন্যপায়ী ও লতাপাতা। গাছের প্রাকৃতিক গর্তে এরা আবর্জনা ও কোমল পালকের স্তূপ বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমের রং পীতাভ। সংখ্যায় ৬ থেকে ১৭টি হয়। ২৮ থেকে ৩২ দিনে ডিম ফোটে। জুন মাসে প্রজনন ঋতুতে সাইবেরিয়া ও তিব্বতে পুরুষ হাঁস ‘ক্রেহ ক্রেহ’ স্বরে ডাকে। স্ত্রী হাঁস একটিমাত্র শব্দে ডাকে ‘ক্রক’, তবে শীতের আবাসে এরা কদাচিৎ ডাকে।
এদিকে, রাজশাহীর পদ্মাপাড়ে চালানো এ পাখিশুমারি ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইইউসিএন-এর বন্যপ্রাণী মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহীতে পাখিরা অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এর কারণ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। জায়গা অনেক বেশি হওয়ার কারণে পাখিরা এখানে আশ্রয় নেয়। এক চরে অনুকূল পরিবেশ না পেলে তারা আরেক চরে উড়ে যায়।
আইইউসিএন-এর আরেক গবেষক সারোয়ার আলম বলেন, আমরা সাধারণত হাওর অঞ্চলের পাখির শুমারি করে থাকি। তবে এ শীত মৌসুমে রাজশাহীতে প্রথম শুমারি করা হয়েছে। রাজশাহীর অভ্যন্তরে থাকা পদ্মা নদীর প্রায় ৩৯ কিলোমিটার অংশে আমরা শুমারি করেছি। যার মধ্যে পবা উপজেলার চরখানপুর, খিদিরপুর, দশনম্বর চর ও চারঘাট অংশ ও খিদিরপুরের মধ্যচরে সবচেয়ে বেশি পাখির বিচরণ দেখেছি।
রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য নূর এ সাউদ বলেন, আমরা সর্বমোট ৪ হাজার ২৫টি পাখি গণনা করেছি। যেগুলো ৩৭ প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে ২৭ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। সবচেয়ে বেশি বিচরণ দেখা গেছে পিয়ং হাঁসের। সৈকত পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে টেমিংয়ের চাপাখি। সবচেয়ে বিরল পাখি ছিল বৈকাল তিলিহাঁস।
শুমারি চলাকালীন আইইউসিএন-এর উদ্যোগে দূর পরিযায়ী এক পাখির পিঠে ট্র্যাকার বসানো হয়েছে। সেই পাখিটির নাম পাতি তিলিহাঁস। ইংরেজি নাম ‘কমন টিল’। এটি দুর্লভ প্রজাতির পাখি। এর মাধ্যমে পাখিটির চলাচলের পথ ও আচরণ সম্পর্কে তথ্য জানা যাবে। প্রতি ঘণ্টায় মোবাইল ফোনে এর গতিবিধির হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে পদ্মা নদীর মাঝারদিয়াড় এলাকায় পাখিটি ছেড়ে দেওয়ার পর মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত পাখিটি সাড়ে ৯ কিলোমিটার ভ্রমণ করেছে। তখন পর্যন্ত তার সর্বশেষ অবস্থান ছিল পবা উপজেলার চরখানপুর এলাকায়।
আইইউসিএন-এর গবেষক সারোয়ার আলম জানান, হাঁস জাতের পাখিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। এটির ওজন ৩১০ গ্রাম। এটি সবচেয়ে দূর পরিযায়ী হাঁস। ট্যাগের ওজন প্রায় ১০ গ্রাম, যা পাখির শরীরের ওজনের মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে এর স্বাভাবিক চলাফেরায় কোনো সমস্যা হবে না। গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এটি বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। পাখিদের সুরক্ষার জন্যও এটি একটি কার্যকরী পদ্ধতি বলেও উল্লেখ করেন আইইউসিএন-এর গবেষক সারোয়ার আলম।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২০
এসএস/আরবি/