সিলেট: শীত বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে চলছে বসন্তকাল। বসন্তে মনের সুখে কোকিল ডাকে, বৃক্ষ-লতাগুল্মে গজায় নতুন পাতা, গাছে গাছে ফুটে ফুল, ধরে ফল।
নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে যেমন পুরো নদীটাই ভরাট হয়ে যায়। তেমনি বর্ষায় নাব্যতা কমে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই ভরে ওঠে সুরমা। দেখা দেয় বন্যা। নাব্যতা হারানোয় এই মৌসুমে নদীপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে অতিরিক্ত মূল্যে যানবাহনে পণ্য পরিবহনের ঘানি টানতে হচ্ছে কৃষক থেকে ক্রেতা, সবাইকেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, সুরমার উৎসমুখ জকিগঞ্জের আমলসীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এলাকায় চর জেগেছে কমপক্ষে ৩৫টি। সিলেট নগর সংলগ্ন কুশিঘাট, কুশিটুক, শ্রীরামপুর, কাজিরবাজার, শহরতলীর মেন্দিবাগে নদীগর্ভে চর জেগে খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। সেই মাঠ থেকে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিক্রি হচ্ছে মাটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দীর্ঘতম সুরমাকে বাঁচাতে ১৯৯৭ সালে নদী খননের পরিকল্পনা নিলেও তা আটকে যায় প্রতিবেশি দেশ ভারতের বাধায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তরা বলছেন, এই নদীর অন্তত ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকায়। ফলে ভারতের সম্মতি না পাওয়ায় খননের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এরপর ২০১৮ সালে সিলেট সদর ও বিশ্বনাথ এলাকার নদীর কিছু চর খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সুরমার ১১০ কিলোমিটারই পড়েছে সিলেটে। গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০/৪৫ শতাংশে চর পড়েছে। যেখানে চর পড়েনি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) কুশিঘাট, কুশিটুক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর বুকে বিশাল চর জেগেছে। শুকিয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে সুরমা। যেটুকু স্থানে পানি আছে, সেখান দিয়ে লোকজন পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছেন। কোথাও খেয়া চলছেও তলদেশ ভরাট হয়ে পড়ায় ঠাঁই মিলছে মাঝির হাতে থাকা লগি-বৈঠার। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে খেলা করছে দূরন্তপনা শিশু-কিশোররা।
কুশিটুকের বাসিন্দা হাজি আব্দুল আলীম, রাজা মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, এই মৌসুমেও সুরমা দিয়ে জাহাজ চলতে দেখেছি। এখন তো নৌকাও চলে না। নদী ভরাটের কারণে সুরমার সঙ্গে যুক্ত সব খালে শুকিয়ে গেছে। এছাড়া নগরের কাজিরবাজারের ময়লা আবর্জনা গিয়ে পড়ছে সুরমায়। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে চর জাগাচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ফেলা আবর্জনার ভাগাড়। আর সুরমার বুকে স্থাপিত কাজিরবাজার সেতুর চার পিলার যেন নদীর অর্ধেক অংশজুড়ে আছে। ফলে খুঁটির পেছনে ভরাট হয়ে জাগছে চর।
সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার আব্দুল করিম কিম বাংলানিউজ বলেন, সুরমার উৎসমুখ দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ হয়ে আছে। এই করণে শুষ্ক মৌসুমে সুরমায় পানি আসে না। সব পানি চলে যায় কুশিয়ারা নদীতে। শুষ্ক মৌসুমে সুরমায় অল্প যে পানি দেখা যায়, তা লোভা নদীর পানি। যে কারণে চর পড়ছে সুরমায়। এছাড়াও চর পড়ার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন, পাহাড় টিলা কাটার কারণে প্রচুর পরিমাণ মাটি নেমে আসে। নদী সেই মাটি ধারণ করতে পারে না বিধায় ভরাট হচ্ছে সুরমা।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ নেই। সুরমাকে তার মূল উৎস বরাকের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া। শুষ্ক মৌসুমে চর খনন দরকার। নদী খনন বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না। যারা খননের কাজ পান, তারা কোনোমতে দ্রুত খনন দেখিয়ে টাকা নিয়ে যান। খনন পরিকল্পিতভাবে করলে তবেই নাব্যতা ফিরে পাবে সুরমা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বাংলানিউজকে বলেন, বরাক উপত্যাকায় সুরমার উৎসমুখ খননে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ নিয়ে সচিব পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। এর আগে ১৯৯৭ সালে একবার সুরমার উৎসমুখ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। তখন কিছু জরিপ কাজও চলে। কিন্তু ভারতের সম্মতি না পাওয়ায় সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি।
এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী সুরমার নাব্যতা বাড়াতে কানাই থেকে ছাতক পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) খননের উদ্যোগ নিয়েছে। আর ভাঙনরোধে পাউবো সিলেটের সদর উপজেলায় ৮৫০ মিটার ও বিশ্বনাথের রাজাপুর পর্গনাবাজার পর্যন্ত ৮০০ মিটার এলাকায় কাজ চলতেছে। ২০১৮ সালে পাউবোর ঢাকার কার্যালয় থেকে সিলেট ও বিশ্বনাথ উপজেলায় সুরমার জেগে ওঠা চর খননের এই প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানও হয়েছিলো।
সিলেটের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নদী সুরমা। ভারতের বরাক নদ আসামের করিমগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত জকিগঞ্জের বরাক মোহনায় এর উৎপত্তি। সেখান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। সুরমা সিলেট নগর ও সুনামগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। ২৪৯ কিলোমিটার বা ১৫৫ মাইল দৈর্ঘ্যের নদীটি সুনামগঞ্জ জেলার বাউলাই নদীর মোহনায় মিশেছে। বর্ষায় বন্যাপ্রবণ সুরমায় শীতে দেখা দেয় নাব্যতা সংকট।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০২১
এনইউ/এএটি