ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

জোরাল হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের দাবি

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, শেখ হেদায়েতুল্লাহ, <br>খুলনা প্রতিনিধি ও এম আকবর টুটুল, বাগেরহাট প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
জোরাল হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের দাবি

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, সুন্দরবন দিবস। ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিগত বছরের এবারও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি।



২০০১ সালে পরিবেশবাদী ছোট বড় ৭০টি প্রতিষ্ঠান মিলিত ভাবে সুন্দরবন দিবসের সূচনা করে। সেই থেকে নিয়মিত ভাবে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের বহুমাত্রিক সংকট পার করছে। এর সাথে সুন্দরবন ঘেঁষে বাগেরহাটের রামপালে বাস্তবায়নাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্প নতুন ভাবে সংকট সম্ভাবনা তৈরী করছে।

পরিবেশবাদী ও স্থানীয়রা মনে করছেন, এ প্রকল্প সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এ প্রকল্প বড় ধরণের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই সুন্দরবন দিবসে আলোচিত এ প্রকল্প বন্ধের দাবিতে আরো সোচ্চার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা ।
অন্য বছরের মত এবারও সুন্দরবন দিবসের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে বিভাগীয় শহর খুলনায়। নগরীর ফারাজীপাড়ায় রূপান্তর এনজিও’র অডিটরিয়ামে সুন্দরবন একাডেমীর আয়োজনে কর্মসূচির মধ্যে থাকছে সুন্দরবনের চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা, পরিবেশ বিষয়ক রির্পোটিং এর জন্য শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্র সাংবাদিকতা পুরস্কার প্রদান, সুন্দরবন দিবসের বিশেষ প্রকাশনা ‘বাদাবন’এর প্রকাশনা উৎসব।  

সুন্দরবন দিবস উপলক্ষে বাংলানিউজের সাথে কথা বলেছেন পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা। সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশীপ (সিডিপি)-এর নির্বাহী পরিচালক এস জাহাঙ্গীর হাসান মাসুদ বাংলানিউজকে জানান, আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ সুন্দরবন অপরিহার্য। সুন্দরবনের ক্ষতি হবে এমন কোনো উন্নয়ন আমরা চাই না। কিছু করতে হলেও পরিবেশ-প্রতিবেশ ঠিক রেখে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করেই তা করতে হবে।
খুলনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাপা খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন জনবসতিপূর্ন এলাকায় কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছি আমরা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাবে সুন্দরবনের বায়ু, পানি, মাটি দূষিত হবে। জীববৈচিত্র্যে নেমে আসবে বিপর্যয়। সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির যে ক্ষতি হবে তা পূরণ হবার নয়।

তিনি বলেন, এই প্রকল্পে পশুর নদী থেকে প্রতিদিন ২৪ হাজার ঘনফুট পানি উত্তোলন করা হবে। এতেও আমাদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।

সুন্দরবন দিবস আয়োজনের অন্যতম প্রধান সহযোগী রুপান্তর এনজিও। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম খোকন বাংলানিউজকে বলেন, রামপালের কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ ঘাটতি কমালেও স্পর্শকাতর বনাঞ্চল সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরা সরকারের কাছে সুন্দরবনের স্বার্থ বিরোধী এ প্রকল্প বন্ধের দাবি জানাই।    

সুন্দরবনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হলে তা আদৌ ক্ষতির কারণ হবে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তবে সকলেই বনের স্বার্থ বিঘ্নিত হোক এমন কিছু না করার পক্ষে মত দিয়েছেন।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনভিকালচার বিভাগের প্রধান ড. মাসুদুর রহমান এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সকলের। বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হয় এমন প্রকল্প নেয়া উচিত নয়। তবে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি এখনো ক্ষতির কারন কিনা তা নিয়ে এখনো গবেষণা হয়নি। গবেষণা সম্পন্ন হলেই এ বিষয়ে বলা যাবে।
 
অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান। পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘ দিন ধরে।
সুন্দরবনের সংকট-সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে সুন্দরবন দিবসের প্রাক্কালে তিনি কথা বলেন বাংলানিউজের সাথে।

ড. দিলীপ কুমার বলেন, ‘সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। গত ৩০ বছরে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে একে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা না করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ মনে করার পক্ষে আমি। ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের চরিত্রই হচ্ছে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা।

তিনি মনে করেন, আলোচিত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও এর যে প্রাণশক্তি রয়েছে, তাতে এ সংকট মোকাবেলা করতে পারবে সুন্দরবন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বনের কিছু বৃক্ষ বা প্রাণি বৈচিত্র্য হয়ত হারাবে, তবে নতুন করেও অনেক প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে। তবে সংকট তৈরী করছে সুন্দরবনের উজানে ও বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে সুন্দরবনের নদী-নালা-খালের পানি প্রবাহকে সংকুচিত করে ফেলা। মানবসৃষ্ট এসব চাপমুক্ত করা খুবই জরুরি।

ড. দিলীপ আরো মনে করেন, সুন্দরবনের পলিউশন লোড নেই। সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের যে সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এর ফলে বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি হবে কিনা তা নির্ভর করছে ব্যবহৃত কয়লার মানের ওপর। প্রয‍ুক্তি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। ভাল ব্যবস্থাপনা থাকলে হয়ত ক্ষতি হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের শুরু ভাল-শেষ খারাপ, এ বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। সুব্যবস্থাপনার জন্য রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ড. দিলীপ।  
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম শুরু থেকেই সুন্দরবন দিবসের আয়োজনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। স্থানীয় অধিবাসীদের সচেতন করে তোলার মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় ‘সুন্দরবন মায়ের মতন’ থিমে পাঁচ বছর ব্যাপী একটি ক্যাম্পেইনও চলতি মাসেই শুরু করতে যাচ্ছে ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট।

ড. আনোয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় স্থানীয় অধিবাসীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন মায়ের মতন আমাদের আগলে রাখে, বনের বাঘ, হরিণ, কাঠ বা অন্যসব বনজ সম্পদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই-এর ক্ষতি করা যাবে না, স্থানীয়দের এমন মূল্যবোধ তৈরী করা গেলে অনেক সংকট লাঘব হবে।
সুন্দরবন ঘেঁষে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গে ড. ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া বাঁচা যাবে না, সব উন্নয়ন কাজে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তবে সুন্দরবনের এত কাছাকাছি করাটা ঠিক হচ্ছে না।

কারণ এ প্রকল্প সুন্দরবনের জন্য কি ধরণের ক্ষতির কারণ হবে, তা এখনো নিরুপিত হয়নি। শিল্প বিপ্লবের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কি দশা হয় তা দেশের শিল্প অধ্যুষিত অন্য এলাকাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে। সর্বোপরি সুন্দরবনের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে সেখানে বাঘ ও অন্য বন্যপ্রাণীরা থাকবে না। আর এরা না থাকলে বন টিকে থাকবে না। যার ফলে সেখানে মানুষের অস্তিত্বও টিকে থাকা কঠিন হবে।

উল্লেখ্য, জলজ ও বনজ সম্পদে ভরপুর প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। বর্তমানে সুন্দরবনের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়। জলবায়ু পরিবর্তন না মানবসৃষ্ট কারণ এর জন্য দায়ী তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি সুন্দরবন ঘেঁষে বাগেরহাটের রামপালের গৌরম্ভা এলাকায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ ভাবে এমইউ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সুন্দরবনের জন্য এ প্রকল্প নতুন করে সংকট তৈরী করবে-দাবি করে তখন থেকে এই প্রকল্প বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।  

বাংলাদেশ সময় : ফেব্রুয়ারি  ১৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।