নড়াইল: ‘আয় রে আয় টিয়ে
নায়ে ভরা দিয়ে
না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে।
তা দেখে দেখে ভোঁদড় নাচে’।
শৈশবে পড়া এই ছড়ায় ভোঁদড় নামক প্রাণীটি পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হলেও এখনও এর দেখা মেলে নড়াইল জেলায়। পৃথিবীর এই একটি এলাকায়ই ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার প্রায় ৫শ বছরের প্রাচীন পদ্ধতিটি এখনও টিকিয়ে রেখেছে নড়াইলের গোয়ালবাড়ির ৫টি পরিবার।
স্থানীয়রা আঞ্চলিক ভাষায় ভোঁদড়কে ‘ধেড়ে বা ধাইড়ে’ বলে। এখানে জাল, জেলে আর ভোঁদড় এই তিনে মিলে যেন একটি সংসার।
ভোঁদড়ের প্রধান খাবার হলো মাছ। তবে, ব্যাঙ বা ছোট আকৃতির জলজ পোকাও খেয়ে থাকে। জেলেরা যখন মাছ ধরতে না যায় তখন মাছ কিনে তাদের খাদ্যের জোগাড় করা হয়। প্রতিটি ভোঁদড় বছরে দুই থেকে ছয়টি বাচ্চা দেয়। এরা অন্তত ৯-১০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি গ্রামের ধ্রুব বিশ্বাস, শ্যাম বিশ্বাস, নবীন বিশ্বাস, রবিন বিশ্বাস ও ভবেন বিশ্বাস। এই পাঁচ পরিবার পাঁচটি নৌকায় ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। এখানে বছর দশেক আগে শ’খানেক ভোঁদড় থাকলেও বর্তমানে ওই পাঁচ পরিবারের মোট ২১টি ভোঁদড় রয়েছে।
সাধারণত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা। বছরের এই কয়েক মাস যা আয় হয় তাই দিয়ে সারাবছর চলতে হয়।
স্থানীয় চিত্রা নদীতে মাছ কমে যাওয়া ও খাল-বিল, নালাগুলোতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরেন অন্য জেলেরা। ফলে প্রর্যাপ্ত আয় না থাকায় অনেকে ভোঁদড় বিক্রি করে দিয়েছেন তারা। একটি ভোঁদড় প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
সরেজমিনে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোঁদড় পানিতে নেমে মাছ শিকার করে খেতে পছন্দ করে। প্রতিটি জেলে নৌকার এক প্রান্তে ভোঁদড়ের জন্য আলাদা করে খাঁচা বানানো থাকে। মাছ ধরার সময় খাঁচার ডালা খুলে দেওয়া হয়। জেলেরা নৌকায় বাঁধা জাল নদীতে ফেলে ভোঁদড় ছেড়ে দেন। এ সময় লাঠির সঙ্গে এদের শরীর এমনভাবে বাঁধা থাকে, যেন ছুটে হারিয়ে যেতে না পারে। নৌকা নদীর তীরে আসতে থাকে আর ভোঁদড়ের তাড়া খেয়ে মাছগুলো জেলেদের জালে এসে ধরা পড়ে।
গোয়ালবাড়ি গ্রামের জেলে শ্যাম বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কয়েক পুরুষ ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে আসছিলেন। ঠাকুরদা গদাধর বিশ্বাস, বাবা নিরাপদ বিশ্বাস থেকে আমি এ পেশায় আছি। কত বছর হবে তার সঠিক হিসাব না থাকলেও দুই থেকে তিনশ বছর ধরে চলছে।
ধ্রুব বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, আগে নদীতে মাছ ছিল, অনেক আয় হতো। কিন্তু দিন দিন নদীতে মাছ কমে যাওয়া, অন্য জেলেদের নদীতে কারেন্ট জাল পাতা আমাদের ব্যবসা মন্দা। তাছাড়া আগে সুন্দরবনের আশপাশে মাছ ধরার পাস ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। এখন প্রতি রাতে যা আয় হয় তা দিয়ে আর সংসার চলে না।
নবীন বিশ্বাসের কলেজপড়ুয়া ছেলে দেব বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী পেশা হলেও আমাদের প্রজন্মের ছেলেরা আর এ পেশায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই। প্রায় ৫শ বছরের পুরনো এই মাছ ধরার পদ্ধতি হয়তো আগামী ৫/১০ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
শ্যাম বিশ্বাসের স্ত্রী লতিকা বাংলানিউজকে বলেন, মাসখানেক আগে একটি ভোঁদড় ৪টি বাচ্চা দিয়েছে। এদের এখনো বাজার থেকে ছোট মাছ কিনে খাওয়াতে হচ্ছে। প্রথম দিকে মানুষের মতো ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়াতে হতো। দেড়-দুই মাস বয়স থেকে এরা নিজেরা মাছ ধরে খেতে পারবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এইচ এম বদরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা জেলেদের নিয়ে আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে, এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে ওইসব জেলেদের জন্য প্রণোদনার প্রস্তাবনা করা হবে ও তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২২
এএটি