ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

ভারত ও নেপালে একটুখানি বেড়ানো

ইরানী বিশ্বাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১০
ভারত ও নেপালে একটুখানি বেড়ানো

৮ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী বাসে চড়ে বসলাম। এ গাড়িটি সার্ভিস দেয় ঢাকা টু শিলিগুড়ি।

ভাড়া মাথাপিছু ১ হাজার টাকা। গাড়ি চলতে লাগল। রাত বেড়ে চলছে, আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল হতে হতেই ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখি আমরা মাত্র সিরাজগঞ্জ এসেছি। ঈদের আগে এ রাতটা ছিল খুব যানজটপূর্ণ। বাংলাদেশের বুক চিরে গাড়িটি এগিয়ে চলল। জানালার ফাঁক দিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এ সবুজ যেন স্বপ্নের রঙতুলিতে আঁকা। বিকেল ৫টার দিকে আমরা রংপুরের বুড়িমারী বর্ডারে নামলাম। আমাদের পাসপোর্ট জমা নিয়ে নিল বাসের কন্ডাক্টর। আমরা বর্ডার ক্রস করলাম। মেয়ে নাইস বিরক্ত করতে লাগল, সে কখন ভারত দেখবে। বর্ডার পার হয়ে ওপারে যেতেই বললাম, এখন আমরা ভারতে। নাইস ভীষণ খুশি। ইমিগ্রেশন করতে অনেক সময় লেগে গেল। ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যায় আসে। কিন্তু ভারত সরকার এ জায়গাটার কোনও উন্নয়ন করছে না কেন, জানি না। এখানে ইমিগ্রেশনের জন্য একজন মানুষকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা থাকতে হয়। অথচ নেই পর্যাপ্ত লাইটের ব্যবস্থা। নেই টয়লেট, পানীয়জলের সুব্যবস্থা। কেন এই অবহেলা? শুধু বাংলাদেশের মানুষ যাতায়াত করে বলে? আমরা আবার শ্যামলী বাসে উঠে বসলাম। ততক্ষণে রাতের আধারে ঘিরে ধরেছে চারপাশ।

আমাদের বাস চলতে লাগল চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির উদ্দেশে। রাস্তা এত খারাপ যে বাসে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। বাস চলছিল খুব ধীরে ধীরে। অন্ধকার চিরে বাস এগিয়ে চলছে। কোচবিহার পার হয়ে আমরা মহানন্দা ব্রিজে উঠলাম। দূরে রেলব্রিজে নিয়ন আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে গেলাম জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি। তখন রাত ১১টা ৩৫। বাস থামল শ্যামলী কাউন্টার হোটেল রিসেন্ট প্লাজার সামনে। বাস থেকে কোনওমতে নেমে আমরা হোটেলের রিসিপশনে দাঁড়ালাম। একটি রুম বুক করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর রেস্টুরেন্টে এসে খাবার খুঁজতে লাগলাম। ভাত, সবজি আর চিকেন পাওয়া গেল। গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।

দু দিনের জার্নিতে অনেক টায়ার্ড হয়ে গেছি। তাই ঘুম ভাঙল দেরিতে। সকাল ১০টার দিকে আমরা রেডি হয়ে বের হলাম। ব্রেকফার্স্ট করে একটি জিপে চড়লাম। উদ্দেশ্য দার্জিলিং। শিলিগুড়ি টু দার্জিলিং জনপ্রতি ভাড়া একশ টাকা। কিছুদূর যাওয়ার পর জিপের ড্রাইভার মনে করলেন এ জিপ নিয়ে পাহাড়ে ওঠা যাবে না। তাই তিনি অন্য একটি জিপের ড্রাইভারকে ফোন করলেন। ২০ মিনিটের মধ্যে অন্য একটি জিপ চলে এল। জিপ চলতে লাগল। দু পাশে ঘন সবুজ প্রান্তর। একপাশে লম্বা লম্বা শাল গাছ, অন্য পাশে চা বাগান। কিছুদূর যাওয়ার পর আমারা পাহাড়ি পথ ধরলাম। দার্জিলিং যাচ্ছি ভাবতেই মনের মধ্যে উষ্ণ শিহরণ অনুভব করলাম। এর আগে অবশ্য রাঙামাটির পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরেছি। তবে এখানকার রূপ রাঙামাটি থেকে ভিন্ন। সমতল থেকে প্রায় ১ হাজার ফুট উঁচুতে যাচ্ছি আমরা। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাগুলোকে দেখলে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে কে যেন জরির ফিতে জড়িয়ে রেখেছে। দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘরবাড়ি করে বসবাস করছে মানুষ। দেখে মনে হয় সবুজ পাহাড়ে ফুলের মেলা বসেছে। রাতে আরও ভালো লাগে। দূরের পাহাড়গুলোকে মনে হয় আকাশ । আর তার গায়ের ঘরবাড়িতে জ্বলে ওঠা বাতিগুলোকে মনে হয় তারার আলো। প্রকৃতির এত অদ্ভুত খেয়াল ঘর ছেড়ে বাইরে না এলে বোঝা যায় না।

দার্জিলিং পাহাড়ের মাঝামাঝি যেতেই আমাদের জিপ ব্রেক কষল। যে যার মতো নেমে গেলাম একটি ছোট খাবার হোটেলের সমানে। সারি সারি চেয়ার-টেবিল রয়েছে। আমরা সুবিধামতো স্থানে বসে পড়লাম। দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত খাবার মোমো। আমরা এক প্লেট মোমো চাইলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে গরম ধোঁয়া ওঠা এক মোমো হাজির হলো। এটা আসলে ময়দার তৈরি। ছোট ছোট গোলাকার ময়দার পিঠার মধ্যে লবণ স্বাদের সবজির পুর। এটি ভাপা পুলির মতো সিদ্ধ করা। টকটকে লাল লংকার সসে চুবিয়ে খেয়ে নিলাম পেটপুরে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ সুযোগে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা খেয়ে নিলাম। চলতে শুরু করল আমাদের জিপ। আমি বসেছি ড্রাইভারের পাশের সিটে। সামনে থেকে দেখতে সুবিধে হওয়ার জন্য। ড্রাইভারটি মোটামুটি বাংলা বোঝে। জানালার কাচ সরিয়ে বাইরে হাত বাড়াই, মেঘ ধরব বলে। এত কাছ থেকে মেঘ দেখব ভাবতে পারিনি। পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে গেল। হেড লাইট জ্বালিয়ে জিপ চালাচ্ছে ড্রাইভার। বললাম, এত অন্ধকার কেন? উত্তরে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, মেঘের মধ্যে পড়েছি। কী আশ্চর্য, আমরা এখন মেঘের দেশে পৌঁছে গেছি! এ যেন রূপকথার সেই কল্পকাহিনী। রাজপুত্র পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে রাজকন্যাকে নিয়ে মেঘের দেশে ভেসে যাচ্ছে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাকা ঘর। তবে অধিকাংশ ঘরের সামনে মাটির টবে নানা রঙের ফুলগাছ। দেখে আমি তো মুগ্ধ। এই কঠিন পাহাড়ে এত সুন্দর ফুল! না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। শুধু কি ঘরের সামনে! পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালার অপরূপ সৌন্দর্য যেন আমাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। ওরা আমাকে দার্জিলিং আসার জন্য স্বাগত জানাচ্ছে। চোখের চশমা সরিয়ে দু চোখের দৃষ্টিতে সবুজের পরশ নিলাম। যেন সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে সাজিয়েছেন এ প্রকৃতি। সারি সারি ঝাউগাছের কালচে সবুজ রঙে আমার দু চোখ জুড়িয়ে গেল। ভাবলাম, এখানে যারা বাস করে তাদের কখনো চশমা পরতে হবে না। সকালের প্রথম সূর্যের আলোয় চোখ মেলে তারা সবুজ আর সবুজ দেখে আর সূর্যের শেষ আলোয় ঘরে ফেরে। সারাদিনের কান্তি আর অবসর সবসময় তারা সবুজের ভেতরেই থাকে।

আমরা পৌঁছে গেলাম কারশাং শহরে। এখানে অধিকাংশই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে। এসব বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের থাকা খাওয়ার জন্য আছে হোস্টেল/বোর্ডিং। এখানে গেলে দেখা যাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে স্কুল আর স্কুল। আর ছেলেমেয়েদের কত ধরনের ইউনিফর্ম। যে যার মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। চেহারায় কেউ বাঙালি, কেউ নেপালি, চায়নিজ, আফ্রিকান বা ব্রিটিশ। ইংলিশ স্কুলের জন্য বিখ্যাত শহর কারশাং পার হয়ে জিপ চলতে লাগল আরও সামনে। রাস্তার এক প্রান্ত ধরে এগিয়ে গেছে ট্রেন লাইন। এটি শিলিগুড়ি টু দার্জিলিং আপ-ডাউন করে, এর নাম টয়ট্রেন।

আমার কৌতূহলের শেষ নেই। তাই ড্রাইভারকেই গাইড ভেবে নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছি। তার কাছে জানতে চাইলাম দার্জিলিংয়ে জনবসতি গড়ে ওঠার ইতিহাস। তিনি একনাগাড়ে বলে চললেন, ভারতে প্রথম রেললাইন চালু করে ব্রিটিশরা। এর আগে এ স্থানের মানুষ জলপথে অথবা ঘোড়ায় চেপে যাতায়াত করত। ভারতের এত সৌন্দর্য দেখে ব্রিটিশরা মুগ্ধ হয়েছিল। তারা ভারতের সম্পদ ও সম্ভাবনা খুঁজতে লাগল। এ সময়ে ভারতে ছিল প্রচুর জঙ্গল। ব্রিটিশরা জঙ্গলের কাঠ সংগ্রহের কাজে শ্রমিক নিয়োগ দিল। ঘন অরণ্যের মধ্যেই দার্জিলিং পাহাড়ের সন্ধান পেল তারা। এমন কি এ অঞ্চলের আবহাওয়া তাদের খুব আরামদায়ক মনে হলো। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল, পাহাড়ের চূড়া জয় করার। শুধু তাই নয়, পাহাড়ের গায়ে চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পেল। তাই পাহাড়ের খাদে খাদে রাস্তা নির্মাণের নকশা করা হলো। এ কাজে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন। ব্রিটিশদের হাতে বন্দি কয়েদিদের রাস্তা নির্মাণের কাজে নিয়োজিত করা হলো। পাহাড়ের গায়ে চা চাষের জন্য জনশক্তি আনা হলো। তাদের নিয়োগ করা হলো চা উৎপাদন কাজে। আর  এভাবেই ধীরে ধীরে এখানে জনবসতি শুরু হয়।   দার্জিলিংয়ে কোথাও তেমন দার্জিলিং নাম দেখা যায় না। এ জায়গাটির নাম গোর্খাল্যাণ্ড। দার্জিলিংয়ে বসবাসকারীরা নিজেদের গোর্খা বলে দাবি করেন। এখানকার মানুষ হঠাৎ ফুঁসে ওঠেন আন্দোলনের নামে। ভারত থেকে আলাদা হয়ে গোর্খাল্যান্ডের সার্বোভৌমত্ব চায় তারা। যেদিন থেকে গোর্খারা বিদ্রোহ শুরু করেছে, সেদিন থেকে দার্জিলিং কেন্দ্রের রোষানলে পড়েছে। হয়তো এ কারণে দার্জিলিংয়ের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উন্নয়নের ছোঁয়া পাচ্ছে না। রাস্তাগুলো খুবই বিপজ্জনক। উপরে উঠতে উঠতে মনে হয় এই বুঝি জিপ উল্টে যাবে। মাঝে মাঝে দম বন্ধ করে থাকতে হয়। দু পাশের রাস্তা খুব খারাপ। অধিকাংশ জায়গার পিচ উঠে গেছে। রাস্তার বাঁক ঘোরার জায়গাগুলো খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। যে কোনও সময় বিপত্তি ঘটতে পারে। আগের চেয়ে বর্তমানে দার্জিলিংয়ের দৃশ্য অনেক বদলে গেছে। আমি বুঝতে পারি না, ভারত সরকার কেন এর উন্নয়নে দৃষ্টি দিচ্ছে না!

আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে এসেছি। আমাদের জিপ থামল গান্ধি রোডে। প্রিন্সেস হেটেলের সমানে লাগেজ নিয়ে নেমে পড়লাম। রিসিপশনে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দিয়ে নাম এন্ট্রি করে একটি রুম বুক করলাম। তরতর করে পাঁচ তলায় উঠে সাজানো রুমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কঠিন পাহাড় বেয়ে যেখানে উঠতে হয়, সেখানে লিফটে ওঠার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই লিফট ছাড়াই আমরা পাঁচতলায় অনায়াসে ওঠানামা করতে লাগলাম। প্রচুর শীত অনুভব করলাম। বাংলাদেশে যখন গরমে হাঁপিয়ে উঠেছি, ঠিক তখন এখানে গরম কাপড় পরে বসে আছি। শাওয়ার ছেড়ে স্টিমবাথ নিলাম। বেশ আরাম লাগল।

তিন দিনের জার্নির পর আবারও ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। পেট চোঁ চোঁ করতে শুরু করেছে। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ইচ্ছা হলো মাসালা দোসা খাব। অর্ডার দেওয়া হলো একটি মাসালা দোসা ও ফ্রাইড রাইস। যথাসময়ে হাজির হলো খাবার। কিন্তু খাবার কিছুতেই গলার নিচে নামছে না। আমি বাঙালি বলে ভাত-মাছ আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু বিদেশি খাবার যে খাওয়ার অভ্যাস নেই, তা নয়। বাংলাদেশেও দোসা খেয়েছি, তেমন অসুবিধা হয়নি। এখন তা কিছুতেই খেতে পারলাম না। অগত্যা খাবার রেখে উঠে আসতে হলো। আমরা হাঁটতে লাগলাম মাল রোড ধরে। দু পাশে স্ট্রিট শপ। এটা অনেকটা আমাদের ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের মতো। কম দামে ভালো জিনিস পাওয়া যায়। যেতে যেতে কয়েকটি ভালো জিনিস দেখলাম। দরদাম করে কিনেও নিলাম।  

আমরা হাঁটতে হাঁটতে যেখানে পৌঁছালাম সেটা মাল স্কয়ার। কয়েকটি ঘোড়া নিয়ে বাচ্চা ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। আমার মেয়ে বায়না করল, ঘোড়ায় উঠবে। আমার আবার ঘোড়া দেখলে ভয় করে। অগত্যা নাইস চেপে বসল ঘোড়ার পিঠে। ওকে ঘোড়ায় সাওয়ার করে ছেলেটি চলে গেল দূরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এ জায়গাটি বেশ খোলামেলা। এক প্রান্তে একটি মন্দির রয়েছে। সারি সারি দেবদারু গাছ ঘিরে রয়েছে জায়গাটিকে। মন্দিরটির পাশ ঘিরে বসার বেঞ্চি রয়েছে সারি সারি। এখানকার অধিকাংশ মানুষ বাংলা বলতে পারে। তাই আমার কথা বলতে তেমন কষ্ট হয়নি। জায়গাটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই একজন বলল, এখানে গোর্খাদের প্যারেড করানো হতো। কিছুদিন আগে পুলিশ এটাকে সিল করে দিয়েছে। তাই আর এখানে জমায়েত হয় না। তবে কাল সকালে এখানে পুজো আছে। আসলে দেখতে পাবেন অনেক কিছু। এরই মধ্যে আমার মেয়ে চলে এসেছে। একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। দেয়ালে টাঙানো লিস্ট দেখতে লাগলাম। সবজি পাকুড়া ও কফি অর্ডার দেওয়া হলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। দূরে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো মিটমিট করে জ্বলছে বৈদ্যুতিক বাতি। দেখতে কী সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে আকাশ যেন নিচে নেমেছে। আমাদের সামনে খাবার হাজির। আমরা খুব মজা করে খেতে শুরু করলাম। সেদিনের মতো ফিরে এলাম রুমে।

সকাল থেকে প্রচুর বৃষ্টি। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এত বৃষ্টিতে কোথায় যাব? কোনও যানবাহন নাই। যেখানেই যেতে হবে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। তবু মনে সাহস এনে উঠে দাঁড়ালাম, ছাতা তো আছে। ব্রেকফার্স্ট সেরে ঢাউস আকারের একটি ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে আবার মালস্কয়ারে গেলাম। যেতে যেতে বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। কয়েকশ মেয়ে-ছেলে জড়ো হয়েছে সেখানে। অধিকাংশ মেয়ে লাল জরিবাঁধানো শাড়ি পরে এসেছে। বিবাহিত মেয়েরা সিঁথিজুড়ে লাল টকটকে সিঁদুর পরেছে। কপালে গোলাপি রঙে জড়ানো আতপ চাল লাগিয়েছে। কপালে বিশেষ চাল লাগানোর অর্থ কিছুই বুঝলাম না। সেখানে মাইকে অনেক রাজনৈতিক বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গীতায়োজনও ছিল। আমরা পাশের একটি রেস্টুরেন্টে বসে নুডুলস খেতে খেতে সঙ্গীতায়োজন উপভোগ করলাম। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমরা মাল রোড ধরে হেঁটে আসতে আসতে কিছু শপিং সেরে নিলাম। সেখান থেকে পথ ধরে পাহাড়ের নিচে নেমে গেলাম। একটি বড় মার্কেটের সামনে দাঁড়ালাম। এর নাম ‘বিগ বাজার’। গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি বিরাট দুটি পোস্টার লাগানো। এখানে সিনেমা হলে আজই মুক্তি পেয়েছে সিনেমা দুটি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সিনেমা দেখব। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিলাম। জন প্রতি ১৫০ রুপি। টিকিটের লাইনে উপচেপড়া ভিড় দেখে বিস্মিত হলাম। এত মানুষ সিনেমা দেখে! এ দেশের মানুষ সিনেমাশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে যদি এ রকম পরিবেশ থাকত তবে আমরাও সিনেমা হলে যেতাম। আর আমাদের সিনেমাশিল্পও সমৃদ্ধ হতো। টিকিট হাতে উঠে গেলাম দোতলায়। শুরু হলো সালমান খান অভিনীত ছবি ‘দাবাং’। ছবি শেষ হতে বিকেল। পেট চোঁ চোঁ করছে। একটি তিব্বতি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এ কয়দিনে ভাতের দেখা মেলেনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ভাত খাব। বিগবাজারে কিছু কিছু কেনাকাটা করে আমরা চলে গেলাম অন্য মার্কেটের ভেতরে।

ব্রেকফার্স্ট সেরে আমরা একটি প্রাইভেট কারে চড়লাম। এখানে প্রাইভেট কার ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা যাব রক গার্ডেনে। সারা দিনের জন্য ১৩০০ রুপিতে ঠিক করা হলো প্রাইভেটকারটি। পাহাড় থেকে আবার আমরা সর্পিল গতিতে নিচে নামলাম। রাস্তা খুব ভালো নয় বলে গাড়ির গতি ছিল কম। গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার জানালেন রাস্তা খারাপ, সামনে যাওয়া যাবে না। হেঁটে হেঁটে গেলাম রক গার্ডেনে। রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। দু পাশের পাহাড় ভেঙ্গে পাথর ছড়িয়ে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। বিরাট বিরাট পাথরের ভারে রাস্তা গুঁড়িয়ে গেছে। খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, রক গার্ডেন ছিল বেশ সাজানো-গোছানো। কিন্তু এখনকার পরিবেশ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। এখান থেকে গঙ্গা দেখতে হলে গাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু রাস্তা ভাঙ্গা থাকার কারণে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম। আমাদের গাড়ি চলল দার্জিলিং চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। টিকিট কেটে ঘুরে ঘুরে পশু, পাখি দেখলাম। সেখান থেকে চলে গেলাম চা বাগানে। যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সারিবদ্ধ চা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত চা যেন এখানেই উৎপাদন হয়। সেখান থেকে টাটকা স্বাদের চা খেয়ে আমরা কিনে নিলাম কয়েক প্যাকেট চা।

ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়েছে। কী করব বুঝতে পারছি না। ড্রাইভারকে পাওনা মিটিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। বেলা তখন প্রায় ৩টা। পেটে কিছু না পড়া পর্যন্ত কিছুই ভালো লাগছে না। খাওয়া শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আবারও বিগবাজারে যাব। হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বিগবাজারে। সিনেমার টিকিট কাউন্টারে বিশাল লাইন। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা ৬টার শোতে সিনেমা হলে ঢুকে ‘উই আর ফ্যামিলি’ দেখলাম। সিনেমা শেষ হতে রাত অনেক বেজে গেছে। বেরিয়ে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে হোটেলে গেলাম। এখানে রাত আটটার পর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি পুরো শহরটাই হয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে তখনো। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে হেঁটে হেঁটে রুমে পৌঁছালাম।


সকালে ল্যাগেজ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। আজ আমরা দার্জিলিং থেকে চলে যাব। যথারীতি সকালের খাবার খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি নিয়ে আমরা যাব নেপালের পশুপতি। সকালের চিকচিকে রোদ্দুরকে ম্লান করে মেঘে ছেয়ে গেল চারধার। আবার সেই আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে নেমে এলাম নিচে। এ রাস্তাটা এত প্যাচানো যে মাথা ঘুরতে লাগল। ২ গজ রাস্তাও সোজা চলে না। দু পাশে বড় বড় গাছ। অধিকাংশই ঝাউগাছ। পাহাড়ি পথে গা ছমছম করে। অথচ হঠাৎ করে এক বা দুজন মানুষ চোখে পড়ে। মনে মনে ভাবি এদের কি ভয় বলতে কিছুই নেই? ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এ জঙ্গলে কি বাঘ আছে? তিনি বললেন, আছে তবে ছোট বাঘ। বানর, হরিণ ছাড়াও বিভিন্ন নাম না জানা পাখি আছে। নিঃশব্দ রাস্তায় দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের মিষ্টিমধুর শব্দ। শুকনো পাতার হিসহিস শব্দ। আমরা পৌঁছে গেলাম ভারতসীমান্তে। গাড়ি এপারেই আমাদের ছেড়ে দিল। নেপাল বর্ডারে নাম এন্ট্রি করে একটি কার ঠিক করলাম। ভেতরে বাস দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। কাঠমান্ডু যেতে সময় লাগবে ৩ ঘণ্টার মতো। ভাড়াও বেশি না। নেপালে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। তাই মানিচেঞ্জের প্রয়োজন হয়নি। অনেকণ ঘুরলাম। বেশ ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায় এখানে। এখানকার মার্কেটে অধিকাংশ থাইল্যান্ডের পণ্য। দামেও শস্তা। শপিং করে নিলাম সুবিধামতো। শুরু হলো বৃষ্টি। আমাদের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। একটাও ছবি তুলতে পারলাম না।

নেপাল থেকে আমরা চলে যাব মিরিখ। এটি সমতল থেকে প্রায় ৫ হাজার ফুট ওপরে। যেদিকে তাকাই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে সারি সারি চা গাছ। দূর থেকে দেখে মনে হয় আফ্রিকানদের মাথা। কারণ ওদের মাথার চুলগুলো যেমন সিঁথি করে বিনুনি করা হয় ঠিক তেমন। দু পাশে সবুজ চা বাগান ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। সবুজ স্বপ্নরা আমাদের হাতছানি দেয়। গাড়ি পৌছে গেল মিরিখ। প্রকৃতি কতটা সবুজ হলে মানুষের মন কাড়তে পারে তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। দুপুরের খাবার খাব। তাই ভালো রেস্টুরেন্ট খুঁজতে লাগলাম। অনেক দিন পর এখানে রুইমাছ, ডাল, আলুমটর পেয়ে পেটপুরে ভাত খেলাম। পাহাড়ে প্রচুর মুসম্বি ফল পাওয়া যায়। তাই বিট লবণসহ একগ্লাস জুস খেতে ভুললাম না। বিশাল জায়গা পড়ে আছে। লেকে প্রচুর মাছ দেখা যাচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে দু দ- শান্তির আশায়। সত্যি জায়গাটি শান্তির জায়গা। আগে লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। জানতে পারলাম, কয়েক মাস আগে এখানে বোটিং করতে গিয়ে একটি ছেলে মারা গেছে। তাই কর্তৃপ আপাতত বোটিং বন্ধ করে দিয়েছেন।

মিরিখ ছেড়ে যাচ্ছি শিলিগুড়ি। গাড়ি এসে থামল শিলিগুড়ি। রুমে গিয়ে প্রথমেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিকেলের দিকে চিন্তা করলাম এখানকার বিখ্যাত কি খাওয়া যায়? রিশকায় চেপে সামনে এগিয়ে গেলাম। রিশকাওয়ালাকে বললাম এখানে বিখ্যাত কী আছে? তিনি বললেন বিখ্যাত খাবার খেতে হলে যেতে হবে রেস্টুরেন্টে। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ‘খানা খাজানা’য়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ছোট ছোট ছাতার নিচে টেবিল চেয়ার বিছানো। একটি ছেলে এসে মেনু ধরিয়ে দিল। ভেজিটেবল পাকুড়ার অর্ডার দিলাম।   অনেক বড় স্পেসে অনেকগুলো ছাতা ছড়ানো আছে। তার নিচে কেউ খাচ্ছে, কেউ খেলছে, কেউ গল্প করছে। আমাদের পাশে একটি টেবিলে কয়েকজন ছেলে বসে বড় বাদশাহী হুক্কা খাচ্ছে। ভাবলাম, এগুলো দিয়ে কী খাচ্ছে? ওয়েটার খাবার নিয়ে এল। সে বাঙালি জেনে তার কাছে হুক্কার গল্প জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটি জানাল, এ হুক্কার কল্কিতে স্ট্রবেরি, আপেল, নাশপাতির টুকরা দেয়া হয়। এক বিশেষ পদ্ধতিতে এগুলোকে ভাপে দেওয়া হয়। বড় আকৃতির নলের সাহায্যে ফ্রুটস ফেভার নেয় মুখ দিয়ে।

আমার মেয়ে কখনো ট্রেনে চড়েনি। তাই সিদ্ধান্ত হলো ট্রেনে কোথাও ঘুরতে যাব। া শিলিগুড়ি রেলজংশনে গেলাম। অনুসন্ধান কেন্দ্রের ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ট্রেনে করে ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে আপ-ডাউন করা যায় এমন জায়গা আছে? তিনি বললেন, আছে তবে লোকাল ট্রেনে যেতে হবে। কাছের স্টেশনে অগ্রিম টিকিট বা রিজার্ভ টিকিট হয় না। আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী আর করা! মনখারাপ করে ফিরে এলাম। পরদিন গেলাম বিধান মার্কেটে। এটি শিলিগুড়ির সবচাইতে বড় হোলসেল মার্কেট। এখানে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকে মানুষ আসে কেনাকাটা করতে। আমরাও গেলাম বিধান মার্কেটে কেনাকাটা করতে। পছন্দমতো অনেক কিছু কেনা হলো। একটি দোকনে লেহেঙ্গা কেনার জন্য যাওয়া হলো।

আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে বললেন, এসব লেহেঙ্গা বসুন্ধরা মার্কেটে ও রাজশাহীতে যায়। অনেক আতিথেয়তা করল আমাদের। অন্য একটি দোকানে গিয়ে আমার মেয়ে একটি বাংলাদেশি পাঁচ টাকার কয়েন বের করে খেলছিল। ওটা ওর প্যন্টের পকেটে ছিল। কয়েনটি দেখে দোকানি বলল, কয়েনটা একটু দাও তো। আমার মেয়ে তার হাতে দিয়ে দিল। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন, বললেন এখানে বঙ্গবন্ধু সেতুর ছবিটা দেখলাম। জানতে পারলাম তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। তাকে কয়েনটি গিফট করলাম। তিনি আমাকে ভারতীয় পাঁচ টাকা দিতে চাইলেন। বললাম, এটা বাংলাদেশের তরফ থেকে আপনাকে উপহার দেওয়া হলো। কয়েনটি পেয়ে খুব খুশি হলেন তিনি।

সকাল থেকে জিনিসপত্র গুছাচ্ছি। আজ আমরা চলে যাব। বাস আসতে বেলা ২টা। বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে আসা সব যাত্রী নেমে গেলেন ভারতে। আমরা সেই বাসে উঠে বসলাম দেশের উদ্দেশে। আমাদের বাস চলছে ভারতের সীমান্তের দিকে। দু পাশে মাঠ আর মাঠ। কোথাও আখের চাষ, কোথাও চা বাগান। সমতলভূমিতে অনেক ঘরবাড়ি, অনেক নাম না জানা ফসল। আমরা এসব কিছু পেছনে ফেলে ছুটছি সামনে। দিনের সূর্য গড়িয়ে পশ্চিমের দিগন্তে মিলিয়ে গেল। গোধূলির শেষ আলোয় আরও একবার চোখ মেলে দেখলাম ভারতের সৌন্দর্য। আমরা পৌঁছে গেলাম ভারতসীমান্ত চ্যাংড়াবান্ধা। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা আবার বাংলার মাটিকে স্পর্শ করলাম। বাস চলতে বাংলাদেশের চেনা সেই পথ ধরে। রাত গভীর হতে লাগল। আমার মনে হতে লাগল এই তো আমার সেই শ্যামলী মা, যার কোলে লালিত হয়েছি এতটি বছর। তাকে ছেড়ে পৃথিবীর কোথাও গিয়ে স্বস্তি নেই। এই বাংলা আমার পরিচয়, আমার অস্তিত্ব।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০৪০, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।