মৌলভীবাজার: গাছজুড়ে ছেয়ে আছে আমের মুকুল! এসব মুকুলের ছড়াছড়ি এতটাই অত্যাধিক যে তাতে দেখা যায় না গাছের সবুজ পাতাও। এমন আনন্দময় প্রেক্ষাপট ঘিরে কারো কারো মাঝে বৃক্ষ সফলতার ভাবনা যেন পেয়ে বসে।
মুকুলের এমন সরব উপস্থিতি দেখে সবাই নিজেদের মতো বলাবলি করে থাকে, কত্ত আম হবে এবার! কিন্তু, এই কথা যদি সত্যে পরিণত হতো তাহলে আমেই সয়লাব হত বাংলাদেশ। আমপ্রিয় মানুষদের আনন্দের যেন কোনো পরিসীমা থাকতো না তখন।
আমঅপ্রিয় মানুষদের কেউ কেউ হঠাৎ আমপ্রিয় হয়ে উঠার সুযোগ পেয়ে যেত। এছাড়া চারদিকে পড়ে থাকতো শুধুই আম আর আম। আমের এমন সহজলভ্যতায় উদ্রেক হত বিরক্তিভাব। একে দেখা মাত্রই কারো কারোর মাঝে সূত্রপাত হত অস্বস্তির।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকেই মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় আম গাছে মুকুল আসতে দেখা গেছে। মুকুলে অনেক পরিমাণে ফুল থাকে। ফুলের শতকরা ২৫ থেকে ৯৮ শতাংশই পুরুষ। প্রতিটি থোকায় দুই/তিনশ থেকে তিন/চার হাজার পরিমাণ ফুল থাকে। প্রতিটি থোকায় পরাগায়নের পরিমাণ শতকরা দুই থেকে তিন ভাগ। প্রখর রোদ, অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং কুয়াশার কারণে পরাগায়ন ব্যাহত হয়।
সত্যিটা হলো- সব ‘মুকুল’ আম হয় না। কী কারণে এমনটা হয়? এ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে যোগাযোগ করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের সঙ্গে।
আম গাছে যত মুকুল আসে তার সবগুলো কী কারণে আমে রূপান্তরিত হয় না- এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা ন্যাচারাল ব্যালেন্স (প্রাকৃতিক ভারসাম্য)। আমের বাম্পার ব্রুমিং (প্রস্ফুটন) হয়েছে। কিন্তু পলিনেশনের কম্পিটেশনে যার সাকসেস হয়েছে তার আম হয়েছে। যার সাকসেস হয়নি তার আম হয়নি। পলিনেশন হওয়াটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। অর্থাৎ স্ত্রী পুষ্প এবং পুরুষ পুষ্পের মিলন। এই দুটো বিষয় যতক্ষণ পর্যন্ত সাকসেস না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুকুলগুলো আমে পরিণত হবে না। ’
‘যেসব ফুলগুলো হাজার ফুলের মাঝে সাকসেসফুললি এই কাজটা করতে পেরেছে তারা পরবর্তী জেনারেশনের জন্য রেডি হয়ে গেছে। আর যারা পারেনি তাদেরটা হয়নি। অর্থাৎ মুকুল ফরমেনন্টেশনের আগেই ঝরে গেছে। পরাগয়ন সাকসেস না হলে আমে পরিণত হবে না। ’
কাঁঠালের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘মানে পুরুষ থেকে পরাগরেণুগুলো স্ত্রীরেণুর গর্ভমুন্ডে গিয়ে পরতে হবে। শুধু পরলেই হবে না, এটা ওখানে জার্মিনেট করে পলেনটিউবের মাধ্যমে তার ওই গর্ভাশয়ে যে অভিউল অর্থাৎ ডিম রয়েছে তাকে ফার্টিলাইজ বা নিঃসিক্তকরণ করতে হবে। যদি ফার্টিলাইজে ব্যর্থ হয় তখন ডিম্বানুটা পচে নষ্ট হয়ে যায়। একই অবস্থা কিন্তু কাঁঠালের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। নিষিক্ত যদি না হলে সেখান থেকে আর ফলে পরিণত হবে না।
ফুলেরা দুই রকমের, একটি স্বপরাগী এবং অপরটি পরপরাগী। স্বপরাগী হচ্ছে মেল-ফিমেল (পুরুষ-স্ত্রী) একই ফুলে থাকে। পরপরাগী হচ্ছে মেল-ফিমেল আলাদা থাকে। সেক্ষেত্রে পরাগয়নের জন্য তাদের বাহক দরকার হয়। যেমন- পিঁপড়া, প্রজাপতি, মৌমাছি, পাখি, প্রভৃতিসহ আরও যত ধরনের প্রাণী আছে যারা ফুল ভিজিট করে তাদের সাহায্যের পুরুষ ফুল থেকে স্ত্রী ফুলে পরাগরেণুগুলো স্থানান্তরিত হয়। সে ক্ষেত্রে যেসব ফুলগুলো পরপরাগী তাদের যদি ফুল ফোটার সময় কোনো বাহক না থাকে তাহলে আর সেখানে ফল হবে না।
আম প্রসঙ্গে ড. জসিম উদ্দিন বলেন, আম স্বপরাগী। আমের একই ফুলে দুটো থাকে। সেন্টারে যে গোল অংশ থাকে সেটা স্ত্রীপাঠ। আর চারদিকে ৪টা/৫টা স্ত্রীপাঠ আছে। ওখান থেকে পোলানরেণুগুলো গিয়ে স্ত্রীপাঠের ওপরের স্টিগমাতে পড়ে। এখানে পরাগরেণুগুলো পড়লেই শুধু হয় না। এখানে পড়ে জার্মিনেট করে ভেতরে যাইতে হয়। তা না হলে কিন্তু ফল হবে না। স্ত্রী ফুলগুলো ঝরে পড়ে যাবে।
মুকুল থেকে পরিপূর্ণ আম হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ তাকে পেরুতে হয়। পোকামাকড়, তাপমাত্রা, পানি, ময়েশ্চার, মাটির নিউট্রেশন প্রভৃতি বিষয়গুলো সফলভাবে সুসম্পন্ন হওয়ার পর তবেই কাঙ্ক্ষিত সুস্বাদু আমের দেখে মেলে বলে জানান ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৩
বিবিবি/এএটি