ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না পানি নিয়ে বের হচ্ছেন দুই নারী।

শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে ফিরে: ৬২ বছর বয়সী হাসিনা খাতুনের পরিবারে নাতি-নাতনি মিলিয়ে মোট সদস্য ৯ জন। বাস করেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে।

স্বামী আর ছেলে আগে কৃষি কাজ করলেও এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন কাজের অভাবে। জেলার বাইরে থেকে তারা কাজ করে যে টাকা পাঠান, তাতে কোনোমতে সংসার চলে যায় ঠিকই। কিন্তু প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে খাবার জন্য যে পানি আনেন তিনি, ৮/৯ জনের পরিবারে সেই এক কলস পানিতে পোষায় না কোনভাবেই! তাই ড্রাম বা বোতল হাতে সাথে নিয়ে আসেন নাতি-নাতনিদেরও। এই পানি পান করেই জীবনধারণ করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।



এই গল্প শুধু হাসিনা খাতুনের নয়, বরং এমন গল্প উপকূলের প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে। পানিতে বাস করেও অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছেন খাবার পানির তীব্র সংকটের জন্য। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছেন। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও পরিবারের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহে পাড়ি দিচ্ছে মাইলের পর মাইল। অনেকে আবার বাধ্য হয়ে পান করছেন পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানি।
কথা হলে হাসিনা খাতুন বলেন, আমরা আগে পুকুরের পানি পান করতাম। বড় ঝড়ের (ঘূর্ণিঝড় আইলা) পর থেকে পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওই পানি এখন আর পান করা যায় না। এখন অনেক দূর থেকে পানি নিয়ে যেতে হয়। অনেকেই আছে যারা আরও দূর থেকে আসে। তাদের আগে পানি দেওয়া হয়। তাদের তুলনায় আমরা কাছের বলে অনেক সময় তাদের দেওয়া হয়, কাছের মানুষ পায় না। পেলেও দেওয়া হয় অল্প। সামনে রমজান। কি বলবো বাবা, ৮/৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না!



খাবার পানি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একই এলাকার ইসমত আরা কবরী বাংলানিউজকে বলেন, আইলার পর থেকে মূল সমস্যা শুরু হয়। আগে কিছু পুকুরের পানি পান করা গেলেও এখন আর সেই উপায় নেই। এখন সব পুকুরের পানিতে লবণ। এলাকায় কোনো টিউবওয়েল নেই। যেগুলো আছে সেগুলো লোনা। ডিপ টিউবওয়েলে যত গভীরে যায়, তত লোনা বাড়ে। ফলে হাতে গোনা দু-একটি পুকুর আর বিভিন্ন প্রকল্পের সুপেয় পানির যে প্ল্যান্ট, সেটাই এখন একমাত্র ভরসা।



স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চৈত্র মাসে এ অঞ্চলের পুকুর-নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। ফলে খাবার পানির জন্য মানুষকে আরও বেশি কষ্ট পেতে হয়। খাবার পানির উৎস পাওয়া কঠিন হয়। দুই-একটি উৎস পেলেও তা বেশ দূরে। ফলে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে কষ্ট করতে হয়। আর মিষ্টি পানির পুকুর থাকলেও তা জলোচ্ছ্বাস, প্রকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পুকুরের পানিও পানযোগ্য থাকে না। হাতে গোনা কয়েকটি উৎস থেকে যারা পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন, তাদেরকে লবণাক্ত পানিই পান করতে হয়। এতে নানা ধরনের রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরেও পাওয়া গেছে এমন চিত্র।



দীর্ঘদিনের এ সমস্যায় উপকূলীয় জনপদের দৈনন্দিন জীবনে পড়ছে প্রভাব। এর ফলে পানি ও স্যানিটেশন সংকট আরও প্রখর হচ্ছে, যা সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা হয়ে পড়েছে জরুরি।

শ্যামনগর উপজেলার আরেক প্রত্যন্ত অঞ্চল গাবুরা। সরেজমিন দেখা যায়, এই ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন শত শত ড্রাম নিয়ে মানুষ ট্রলারে নদী পাড়ি দিয়ে পানি নিতে আসেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদে। এ ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে বেসরকারি খাত চালিত ‘প্রবাহ’ নামক পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে ফিরে যান তারা।



পানি নিতে আসা ট্রলার চালক মেজানুর রহমান বলেন, প্রবাহ প্ল্যান্টের পানিতে লবণাক্ততা নেই। তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে গাবুরার অনেকেই ট্রলারে চড়ে পানি নিতে আসে। আমি নিজেও অনেকের জন্য ড্রামে করে পানি নিয়ে গিয়ে দেই। বিনিময়ে তারা ট্রলারের ভাড়া হিসেবে কিছু অর্থ দিয়ে দেয়। কিন্তু ঝড়-বন্যা হলে তখন পানি নিতে পারি না। তখন পানির কষ্ট আরও বাড়ে। মানুষ ব্যাংকে টাকা জমায় শুনেছি, আর আমরা কলসে পানি জমায় ওই সব দিনের কথা ভেবে। তাও যখন সমস্য হয়, একটুখানি পানিতে সবার হয় না। তবে বৃষ্টি হলে সেই পানি ধরে রেখে তা খাই।

উপকূলের এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জে ‘প্রবাহ’র পানির প্ল্যান্ট আছে দুটি। সকাল থেকেই পানি নেওয়ার জন্য সেখানে মানুষের দীর্ঘ সারি। তাদের কেউ কেউ দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন।  

তারা জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ডিপটিউবওয়েলের পানিও লবণাক্ত। প্রবাহ থেকে সংগ্রহ করা পানিতে সেই সমস্যা নেই। ফলে এই প্ল্যান্ট থেকে দূর-দূরান্ত এলাকায় ভ্যানেও পানি নেওয়া হয়। তবে এই প্ল্যান্টের সংখ্যা আরও বাড়ানোর দাবি স্থানীয়দের।

‘প্রবাহ’ পানি প্ল্যান্ট স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ম্যাক্রো মার্কেটিং করপোরেশনের সিইও অপরূপ আইচ জানান, সাতক্ষীরাসহ দেশের ২২ জেলায় ১১৭টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্ল্যান্ট নিয়মিত পরিষ্কার ও পানির মান পরীক্ষা করা হয়।



শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন সুপেয় পানির সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও নিরাপদ পানি সরবরাহে এগিয়ে এসেছে। আমরা তাদের স্বাগত জানিয়েছি। এছাড়া সরকারিভাবে পানি সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নিয়মিতভাবে খাল খনন ও বৃষ্টি পানি সংরক্ষণের উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। আমরা সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
এইচএমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।