ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না পানি নিয়ে বের হচ্ছেন দুই নারী।

শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে ফিরে: ৬২ বছর বয়সী হাসিনা খাতুনের পরিবারে নাতি-নাতনি মিলিয়ে মোট সদস্য ৯ জন। বাস করেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে।

স্বামী আর ছেলে আগে কৃষি কাজ করলেও এখন পেশা পরিবর্তন করেছেন কাজের অভাবে। জেলার বাইরে থেকে তারা কাজ করে যে টাকা পাঠান, তাতে কোনোমতে সংসার চলে যায় ঠিকই। কিন্তু প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে খাবার জন্য যে পানি আনেন তিনি, ৮/৯ জনের পরিবারে সেই এক কলস পানিতে পোষায় না কোনভাবেই! তাই ড্রাম বা বোতল হাতে সাথে নিয়ে আসেন নাতি-নাতনিদেরও। এই পানি পান করেই জীবনধারণ করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

এই গল্প শুধু হাসিনা খাতুনের নয়, বরং এমন গল্প উপকূলের প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে। পানিতে বাস করেও অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছেন খাবার পানির তীব্র সংকটের জন্য। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছেন। নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও পরিবারের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহে পাড়ি দিচ্ছে মাইলের পর মাইল। অনেকে আবার বাধ্য হয়ে পান করছেন পুকুরের কাদামিশ্রিত ও লবণযুক্ত পানি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন বাসিন্দারা। এ উপকূলীয় এলাকায় যেদিকে চোখ যায়, পানি আর পানি। শুধু খাওয়ার উপযোগী একটু পানি নেই। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে মাস ছয়েক চালিয়ে নিতে পারলেও বছরের বাকি সময় তারা পানির তীব্র কষ্টে পড়েন। গত কয়েক দিনের তাপদাহে খাওয়ার পানির সংকট আরও বেড়েছে। স্থানীয় লোকজন মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যান ও সাইকেলে ছুটে চলেছেন পানি সংগ্রহে।

কথা হলে হাসিনা খাতুন বলেন, আমরা আগে পুকুরের পানি পান করতাম। বড় ঝড়ের (ঘূর্ণিঝড় আইলা) পর থেকে পুকুরের পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওই পানি এখন আর পান করা যায় না। এখন অনেক দূর থেকে পানি নিয়ে যেতে হয়। অনেকেই আছে যারা আরও দূর থেকে আসে। তাদের আগে পানি দেওয়া হয়। তাদের তুলনায় আমরা কাছের বলে অনেক সময় তাদের দেওয়া হয়, কাছের মানুষ পায় না। পেলেও দেওয়া হয় অল্প। সামনে রমজান। কি বলবো বাবা, ৮/৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না!

জাহিদুল ইসলামের বাড়ির সামনের গাছের নিচে ৩ ঘণ্টা ধরে বসে আছেন ৬৫ বছরের নারী মর্জিনা বিবি। পাশে দাঁড়ানো পুষ্প রানী মণ্ডল বলেন, ‘আমাগো পানির বিশাল কষ্ট। ’ তিন কিলোমিটার দূরবর্তী শংকরকাঠি মোল্যাপাড়া থেকে পানি নিতে এসেছেন পুষ্প রানী। ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতিদিন তাকে দুবার পানি টানতে হয় জানিয়ে বলেন, দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়।

খাবার পানি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একই এলাকার ইসমত আরা কবরী বাংলানিউজকে বলেন, আইলার পর থেকে মূল সমস্যা শুরু হয়। আগে কিছু পুকুরের পানি পান করা গেলেও এখন আর সেই উপায় নেই। এখন সব পুকুরের পানিতে লবণ। এলাকায় কোনো টিউবওয়েল নেই। যেগুলো আছে সেগুলো লোনা। ডিপ টিউবওয়েলে যত গভীরে যায়, তত লোনা বাড়ে। ফলে হাতে গোনা দু-একটি পুকুর আর বিভিন্ন প্রকল্পের সুপেয় পানির যে প্ল্যান্ট, সেটাই এখন একমাত্র ভরসা।



স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চৈত্র মাসে এ অঞ্চলের পুকুর-নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। ফলে খাবার পানির জন্য মানুষকে আরও বেশি কষ্ট পেতে হয়। খাবার পানির উৎস পাওয়া কঠিন হয়। দুই-একটি উৎস পেলেও তা বেশ দূরে। ফলে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে কষ্ট করতে হয়। আর মিষ্টি পানির পুকুর থাকলেও তা জলোচ্ছ্বাস, প্রকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পুকুরের পানিও পানযোগ্য থাকে না। হাতে গোনা কয়েকটি উৎস থেকে যারা পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন, তাদেরকে লবণাক্ত পানিই পান করতে হয়। এতে নানা ধরনের রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।

তারা আরও জানান, এলাকার সিংহভাগ নলকূপের পানি লবণাক্ত। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) পদ্ধতিতে পুকুরের পানি ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ মিষ্টি পানির পুকুর ও জলাধার শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু এলাকায় নতুনভাবে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে উঠলেও পানি সংগ্রহ ব্যয় অনেক বেশি। আবার সেগুলোর অধিকাংশই দূরবর্তী এলাকায়। সব মিলিয়ে উপকূলবর্তী শ্যামনগর এলাকাজুড়ে খাওয়ার পানির সংকট প্রকট হচ্ছে।

সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরেও পাওয়া গেছে এমন চিত্র। দীর্ঘদিনের এ সমস্যায় উপকূলীয় জনপদের দৈনন্দিন জীবনে পড়ছে প্রভাব। এর ফলে পানি ও স্যানিটেশন সংকট আরও প্রখর হচ্ছে, যা সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা হয়ে পড়েছে জরুরি।

শ্যামনগর উপজেলার আরেক প্রত্যন্ত অঞ্চল গাবুরা। দেখা যায়, এই ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন শত শত ড্রাম নিয়ে মানুষ ট্রলারে নদী পাড়ি দিয়ে পানি নিতে আসেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদে। এ ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে বেসরকারি খাত চালিত ‘প্রবাহ’ নামক পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে ফিরে যান তারা।

পানি নিতে আসা ট্রলার চালক মেজানুর রহমান বলেন, প্রবাহ প্ল্যান্টের পানিতে লবণাক্ততা নেই। তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে গাবুরার অনেকেই ট্রলারে চড়ে পানি নিতে আসে। আমি নিজেও অনেকের জন্য ড্রামে করে পানি নিয়ে গিয়ে দেই। বিনিময়ে তারা ট্রলারের ভাড়া হিসেবে কিছু অর্থ দিয়ে দেয়। কিন্তু ঝড়-বন্যা হলে তখন পানি নিতে পারি না। তখন পানির কষ্ট আরও বাড়ে। মানুষ ব্যাংকে টাকা জমায় শুনেছি, আর আমরা কলসে পানি জমায় ওই সব দিনের কথা ভেবে। তাও যখন সমস্য হয়, একটুখানি পানিতে সবার হয় না। তবে বৃষ্টি হলে সেই পানি ধরে রেখে তা খাই।

উপকূলের এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জে ‘প্রবাহ’র পানির প্ল্যান্ট আছে দুটি। সকাল থেকেই পানি নেওয়ার জন্য সেখানে মানুষের দীর্ঘ সারি। তাদের কেউ কেউ দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন।  তারা জানান, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ডিপ টিউবওয়েলের পানিও লবণাক্ত। প্রবাহ থেকে সংগ্রহ করা পানিতে সেই সমস্যা নেই। ফলে এই প্ল্যান্ট থেকে দূর-দূরান্ত এলাকায় ভ্যানেও পানি নেওয়া হয়। তবে এই প্ল্যান্টের সংখ্যা আরও বাড়ানোর দাবি স্থানীয়দের।

শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অধিকাংশ নলকূপে পানি কম উঠছে।  

শুধুমাত্র দুর্যোগকালে সরকারিভাবে দুর্গতদের মধ্যে খাওয়ার পানি বিতরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পানি সমস্যা দূরীকরণে শ্যামনগরে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পিএসএফ, আরডব্লিউএইচ (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং), গভীর ও অগভীর নলকূপ, আরও (রিভার্স অসমোসিস), পুকুর, দিঘি, মার (ম্যানেজ অ্যাকুইফার রিসার্চ) মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার পানির উৎস রয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাব ও পুকুর–জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে পানির সংকট বেড়েছে।

‘প্রবাহ’ পানি প্ল্যান্ট স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ম্যাক্রো মার্কেটিং করপোরেশনের সিইও অপরূপ আইচ জানান, সাতক্ষীরাসহ দেশের ২২ জেলায় ১১৭টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্ল্যান্ট নিয়মিত পরিষ্কার ও পানির মান পরীক্ষা করা হয়।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন সুপেয় পানির সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও নিরাপদ পানি সরবরাহে এগিয়ে এসেছে। আমরা তাদের স্বাগত জানিয়েছি। এ ছাড়া সরকারিভাবে পানি সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নিয়মিতভাবে খাল খনন ও বৃষ্টি পানি সংরক্ষণের উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। আমরা সুপেয় পানির সংকট নিরসনে সব সময় কাজ করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
এইচএমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।