শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে ফিরে: দেশের উপকূলীয় উপজেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয় প্রকল্পে বাস করেন গৃহিণী রেখা রানি। একটি কলস ও একটি বোতল নিয়ে আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কলবাড়ীতে আসেন প্রতিদিন।
দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দেওয়ার একটাই কারণ, সুপেয় পানি সংগ্রহ করা। এভাবে আসা-যাওয়ায় পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আনা ওই পানি পান করে জীবনধারণ করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।
উপকূলের এমন অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই সুপেয় পানির জন্য যুদ্ধ করছেন। তাদের কেউ পুকুর, বৃষ্টি বা বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট থেকে সংগ্রহ করা পানি পান করছেন। যারা এসব উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদেরকে লবণাক্ত পানি পান করতে হচ্ছে। এতে নানা ধরনের রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়েছে। আগে শুধুমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলের নদীর পানি পানের অযোগ্য ছিল। এখন অনেক এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানিও পান করা যায় না। ফলে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছে। আর এসব এলাকার মানুষের জীবনে স্বস্তি ফেরাতে উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ সম্প্রসারণ করেছে বেসরকারি খাত পরিচালিত নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহ প্রকল্প ‘প্রবাহ’।
দেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে তীব্র লবণাক্ততার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতের উদ্যোগ ‘প্রবাহ’ কয়েক লাখ মানুষকে সুপেয় পানি সরবারহ করছে। এখন পর্যন্ত এই উদ্যোগের আওতায়, দেশের ২২টি জেলায় ১১৭টি পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার মানুষের মধ্যে ৫ লাখ ৮০ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।
সম্প্রতি এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের লবণাক্ততা-প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে সাতক্ষীরায় বসবাসকারী মানুষের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘প্রবাহ’ পানি প্ল্যান্ট স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ম্যাক্রো মার্কেটিং করপোরেশনের সিইও অপরূপ আইচ জানান, সাতক্ষীরাসহ দেশের ২২ জেলায় ১১৭টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্ল্যান্ট নিয়মিত পরিষ্কার ও পানির মান পরীক্ষা করা হয়। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সহজেই বিশুদ্ধ খাবার পানির যোগান পাচ্ছেন।
শ্যামনগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল গাবুরা। সরেজমিন দেখা যায়, এই ইউনিয়ন থেকে প্রতিদিন শত শত ড্রাম নিয়ে মানুষ ট্রলারে নদী পাড়ি দিয়ে পানি নিতে আসেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদে। এ ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে বেসরকারি খাত চালিত ‘প্রবাহ’ পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট। সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে নিজ বাড়িতে ফিরে যান তারা।
এ বিষয়ে গাবুরার বাসিন্দা মোছা. খাদিজা বেগম বলেন, আগে আমরা পুকুরের পানি পান করতাম। ঘূর্ণিঝড় আইলার সময়ে পুকুরগুলোয় সমুদ্রের পানি ঢুকে যায়। এছাড়া খাল-বিল আটকে দিয়ে চিংড়ি, কাঁকড়ার চাষও বেড়েছে। এসব কারণে পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওই পানি আর পান করা যায় না। কাছাকাছি একটি টিউবওয়েল আছে, যেটার পানি পান করতাম। ওই পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়েছে। তাই সেই পানিও পান করা যায় না। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি আনতে হতো। এখন ‘প্রবাহ’র পানি দেওয়া শুরুর পর থেকে আমাদের কষ্ট অনেক লাঘব হয়েছে। এখন সহজেই নিরাপদ খাবার পানি পাই।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের অধিবাসী শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের এলাকায় নিরাপদ খাবার পানির তীব্র সংকট চলছিল। আমরা পুকুরের পানি পান করতাম, ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হত। কিন্তু ‘প্রবাহ’র পানি পাওয়ার পর আমাদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে।
প্রবাহ কর্তৃপক্ষ জানায়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা নিরসন এবং জনগণকে বিশুদ্ধ পানি সরবারহে সরকারের পাশাপাশি ২০০৯ সাল থেকে কাজ করে আসছে ‘প্রবাহ’। এবারের বিশ্ব পানি দিবসে এই উদ্যোগের ১৪ বছর পূর্ণ হলো। আর রিভার্স অসমোসিস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘প্রবাহ’ প্রকল্পের আওতায় আশাশুনি, শ্যামনগর এবং নলতা উপজেলায় নতুন চারটি পানি পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রায় ১০ হাজারো মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
প্রবাহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থনে কাজ করে আসছে বলে মন্তব্য করেন শ্যামনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন।
এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, সরকারের পাশাপাশি এ ধরনের আরও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলে উপকূলীয় অঞ্চলের বিশুদ্ধ পানির সংকট সমাধান করা আরও সহজ হবে।
আরও পড়ুন>>>৯ জনের পরিবারে এক কলস পানিতে পোষায় না
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৩
এইচএমএস/এএটি