ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

মৃত্যুহীন চে, স্বপ্নবান চে

আহমেদ জুয়েল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১০
মৃত্যুহীন চে, স্বপ্নবান চে

‘আমাকে গুলি করো না, আমি চে গুয়েভারা। আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।

’ কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ চে তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।

কিউবায় বিপ্লবের সফল সমাপ্তির পর কিছুকাল তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কিছুদিন অন্তরালে থাকার পর প্রথমে কঙ্গো, পরে বলিভিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেন। কিন্তু সাম্রারাজ্যবাদীরা তাকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার এক পর্যায়ে সিআইএর সহায়তায় বলিভিয়ান সেনাবাহিনী এক গেরিলা ক্যাম্প থেকে চে-কে আটক করে। একদিন পর ৯ অক্টোবর বিকেলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

চে গুয়েভারা। প্রথমত একজন গেরিলা নেতা। শোষণহীন সমাজ গড়ার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হিসেবেই তার বড় পরিচয়। পুরো নাম আর্নেস্তো গেবারা দে লা সেরনা। সাধারণের কাছে তিনি শুধুই চে, কিংবা চে গুয়েভার (চে গেবারা)। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ অর্থ প্রিয়। কিউবায় সফল বিপ্লবের পর সেখানকার মানুষ অনেক ভালোবেসে তার নাম দেন ‘চে গেবারা’, যার অর্থ ‘প্রিয় গুয়েভারা’। আজ শুধু কিউবায় নয়, পৃথিবীর শত কোটি মানুষের হৃদয়ে তার বসবাস।

চিকিৎসক থেকে বিপ্লবী হয়ে ওঠার জন্য তিনি যে শক্তি অর্জন করেছিলেন তার উৎস ছিল দেখা এবং পড়া। আর এর চেয়েও বড় শক্তির উৎস ছিল মানুষের জন্য ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছেন আরও বেশি। তার বিপ্লবী দর্শনকে স্বাগত জানাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বীরুদ্ধবাদী মুক্তিকামী মানুষ।

কী দেখেছেন?

কী দেখেছেন চে? এ প্রশ্নের উত্তর এটা হতে পারে, তিনি কী দেখেননি। মাত্র তেইশ বছর বয়সে লাতিন আমেরিকার প্রায় পুরোটা ঘুরে দেখেছেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের চাওয়া-পাওয়া, একতাবদ্ধ শক্তি আর প্রতিটি অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা। দেখেছেন শোষকের কালো থাবায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের মুখ, দেখেছেন মার্কিন সাম্রারাজ্যবাদের ভয়াল দৃশ্যপট। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা সদস্যও ছিলেন না। বিশ্ব ভ্রমণের তৃষ্ণা ছিল তার বুকের মধ্যে। গোটা বিশ্বের মানুষের জীবন আর রাজনীতি-অর্থনীতির দৃশ্য খুব কাছে থেকে দেখার ইচ্ছা ছিল। আর তাই ১৯৪৮ সালে বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করলেও ভ্রমণ শুরু করেন ১৯৫০ সালে। প্রথমবার তিনি ভ্রমণ করেন উত্তর আর্জেন্টিনা। বাইসাইকেলে মোটর লাগিয়ে মোটরসাইকেল বানিয়ে ভ্রমণ করেন প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ। এর ঠিক নয় মাস পর ১৯৫১ সালে পড়াশোনা বন্ধ রেখে বছরব্যাপী ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ শুরু করেন। আমাজান নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা পেরুর সান পাওলো লেপার কলোনিতে তিনি অনেকটা সময় কাটান। ওই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ’। তাই এই বই নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় উঠে আসে। ১৯৫৩ সালে আবারও তিনি বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও সালভাদর ভ্রমণে বের হন। মানচিত্রজুড়ে অসাম্য আর মানুষের দুর্দশা দেখে হু হু করে ওঠে তার বুক। খুঁজতে থাকেন ওইসব মানুষের মুক্তির উপায়। মার্কসের বিপ্লবী দর্শনে প্রভাবিত হয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন সশস্ত্র বিপ্লবের।

কী পড়েছেন?

চের প্রিয় সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল কবিতা। স্কুলজীবন থেকেই তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন। বলা যায় কবিতার প্রেমে একেবারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। যুদ্ধক্ষেত্রেও তার অস্ত্রের পাশেই থাকত কবিতার বই। কয়েক বছর আগে উদ্ধার করা তার একটি ডায়েরিতেও দেখা গেছে যুদ্ধের পরিকল্পনা নয়, রাজনৈতিক দর্শন নয়, কিংবা সাম্রারাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও সেখানে কিছু কিছু লেখা নেই। আছে শুধু কবিতা আর কবিতা। পাবলো নেরুদা, জন কিটস, অ্যান্তোনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, গাব্রিয়েল মিস্ত্রাল ছাড়াও অনেক কবির বহু কবিতা তিনি মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারতেন। যুদ্ধের অবসরে তিনি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন সহযোদ্ধাদের। তাদের বাড়িতে প্রায় তিন হাজার বই ছিল। যেগুলোর মধ্যে ছিল কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সালগারিসহ অনেক বিখ্যাত লেখকের বই। এছাড়া জওহরলাল নেহেরু, ফ্রাঞ্জ কাফকা, আলবেয়ার কামু, ভ্লাদিমির লেনিন, জ্যঁ-পল সার্ত্রে, রবার্ট ফ্রস্টসহ অনেকের বইয়ের তিনি ছিলেন পাঁড় পাঠক। মূলত বয়ঃসন্ধির পর থেকে এসব বই পড়ার কারণে সাম্রারাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, অর্থনীতি, রাজনীতি আর স্বাধীনতা সম্পর্কে তার মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়। তৈরি হয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা। বুক ফেটে বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার তৃষ্ণা। আর সেই তৃষ্ণা থেকেই জন্ম নেয় বিপ্লবের বীজ।  

চে বেঁচে থাকলে পৃথিবী থেকে পুঁজিবাদ আর সাম্রারাজ্যবাদ ধ্বংস হয়ে যেত কি-না আমরা জানি না। তবে সাম্রারাজ্যবাদীরা তাকে দারুণ ভয় পেত। এজন্যই তারা চে-কে বেঁচে থাকতে দেয়নি। কিন্তু তিনি কি মরেছেন? মাথায় তারকাচিহ্নিত ফৌজি টুপি, ঝাঁকড়া বাবড়ি চুল, এলোমেলো গোঁফদাড়ি, দু চোখ ভরা ভালোবাসামাখা বিপ্লবী আগুন নিয়ে সুদূরের দিকে চেয়ে থাকা সেই ছবিই মধ্যেই তিনি বেঁচে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়জুড়ে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪১০, অক্টোবর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।