মাদারীপুর: ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার গোলাম মস্তফা রতন। ১৯৫২ সালে মাদারীপুর জেলা থেকে ছাত্রদের বিশাল এক মিছিল নিয়ে নৌপথে ঢাকায় যান তিনি।
করেছেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও। খেটেছেন জেল। এরপর ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। আন্দোলন সংগ্রামের বর্ণাঢ্য জীবন হলেও জীবদ্দশায় চেষ্টার কমতি ছিল না একটু সম্মাননা প্রাপ্তির, রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষাসৈনিক মর্যাদার পাওয়ার!
২০০৮ সালে ব্রেন স্ট্রোকের পর তার স্বাভাবিক জীবন থেমে যায়। দীর্ঘ ১২ বছর শয্যাশায়ী থাকার পর ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জীবিত থাকা অবস্থা থেকেই তার সন্তানেরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাবার ভাষাসৈনিক মর্যাদার জন্য নানা দপ্তরে আবেদন করতে থাকেন। কিন্তু ভাষাসৈনিকের মর্যাদা তিনি পাননি। তবে তার সন্তানদের চেষ্টা থেমে নেই। এখনো চলছে নিরন্তর প্রচেষ্টা। বার বার আবেদন করছেন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে। সাড়া না মিললেও থেমে থাকেননি তারা।
পারিবারিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোলাম মস্তফা রতন ১৯৪২ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে কারাভোগ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় অংশ নেওয়ার জন্য কয়েকটি জেলার ছাত্রদের নিয়ে একটি তালিকা করা হয়। ১৯৫২ তৎকালীন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র গোলাম মোস্তফা রতন ওই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও বরিশাল অঞ্চল থেকে তার নেতৃত্বে দুই শতাধিক ছাত্র নিয়ে লঞ্চে করে ঢাকায় যান। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথের মিছিলে যোগ দেন।
সদর ঘাট থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতেই কার্জন হলের সামনে পুলিশের গুলি শুরু হয়। ওই সময় মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্ররা মাটিতে শুয়ে পড়েন। ফলে তাদের গুলি লাগেনি। কিন্তু গুলিতে সালাম, বরকত, রফিকসহ অনেকেই শহীদ হন সেদিন। গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে মাদারীপুরে ফিরে আসেন রতন।
গোলাম মোস্তফা রতন ১৩৩২ বঙ্গাব্দে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের রামরায়ের কান্দি গ্রামে জন্ম নেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় শিবচরের স্থানীয় নেতা রমনীমোহন চক্রবর্তীর বিশ্বস্ত লোক ছিলেন রতন। ওই সময় তাকে ২০ দিনের মতো কারাবরণও করতে হয়েছিল বলে তার পরিবার জানায়।
ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তিনি চাকরি করেছেন উপজেলার ভদ্রাসন জেসি একাডেমি ও উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে (তৎকালীন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে)। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে স্থানীয়ভাবে কালামৃধা পোদ্দার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সে সময় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন তিনি।
এলাকাবাসী ও স্বজনরা বলেন, আমাদের চাওয়া ছিল মৃত্যুর আগেই যেন তিনি সরকারি স্বীকৃতি পান, কিন্তু সেটা হলো না। গোলাম মস্তফা রতন বহু অর্জনের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই তার মৃত্যু হলেও সরকার যেন একটি সম্মাননা দিয়ে তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দেয়। তাকে যেন সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
গোলাম মস্তফা রতনের মেঝ ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, বাবা বেঁচে থাকা অবস্থাতেই আমরা নয় বার আবেদন করেছি। ভাষাসৈনিক হিসেবে বাবাকে যেন একুশে পদক দিয়ে ভাষাসৈনিকের মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুই হয়নি। ভাষা সংগ্রামে বাবার অংশগ্রহণ, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও বাবা অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। আবেদনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই তা বাতিল হয়ে গেছে। এরপরও আমরা হাল ছাড়িনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রাম থেকে যাওয়া পুরো মিছিলের নেতৃত্ব দেয়েছিলেন বাবা। এ কথা মনে হলেই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। পুলকিত হই একজন ভাষাসৈনিকের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পেরে। কিন্তু আক্ষেপেরও শেষ নেই। এ মহান ভাষাসৈনিকের মূল্যায়ন কেউ করেনি। সরকারি কোনো সম্মাননা তিনি এ পর্যন্ত পাননি। তবে ২০১২ সালে বেসরকারি সংগঠন ‘এইম ওয়ে কর্পোরেশন লিমিডেট’ বাবাকে সম্মাননা দিয়েছিল। সে সময় ৫০ হাজার টাকার চেক দিয়েছিলেন তারা। সম্মাননা বলতে এতটুকুই।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি শিবচরে নতুন এসেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ খবর নিচ্ছি। আমাদের প্রত্যাশা, মহান এ ভাষাসৈনিক যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পান।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান জানান, আগামীতে আবেদন করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাবো এবং আমি চাই, তাকে যেন আগামীতে একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪
এসআই