ইরানের লোরেস্তান প্রদেশের খোররামাবাদ উপত্যকা—যেখানে পাথরের স্তরে লেখা আছে মানুষের প্রথম নিঃশ্বাসের গল্প। এটি এক জীবন্ত গবেষণাগার, প্রথম কৌতূহল আর প্রথম অভিব্যক্তির গোপন ভাষা।
খোররামাবাদ উপত্যকা—জাগরোস পর্বতের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গুহা ও পাথুরে আশ্রয়, যেখানে ৬৫ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিল, প্রথম অলংকার তৈরি করেছিল, প্রথমবার তার অস্তিত্বকে ‘সুন্দর’ বলে উপলব্ধি করেছিল। সেই নিঃশব্দ সূচনার স্থানটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যে ইরানের ২৯তম নিদর্শন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। এটি শুধু প্রত্নতত্ত্বের জয় নয়—একটি জাতির সাংস্কৃতিক কূটনীতির সূক্ষ্ম বিজয়ও।
কালদার গুহা, খোররামাবাদ উপত্যকা
জীবন্ত জাদুঘরে মানুষের শুরু
খোররামাবাদ উপত্যকায় রয়েছে পাঁচটি গুহা— কালদার, ইয়াফতে, কুনজি, গামারি ও গিলোরান। এছাড়া রয়েছে একটি পাথুরে আশ্রয়। প্রায় ৪০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত এই অঞ্চল ঘিরে রয়েছে ৭,০০০ হেক্টরের সংরক্ষণ এলাকা।
এখানে মিলেছে ৪০,০০০ বছরের পুরনো হরিণের দাঁতের তৈরি নেকলেস, যা ব্যক্তিগত অলংকারের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। রয়েছে উন্নত পাথরের হাতিয়ার, আগুন ব্যবহারের চিহ্ন এবং বসবাসের কাঠামো। এই নিদর্শনগুলো শুধু বসতি নয়— বুদ্ধির বিকাশ ও আত্মপরিচয়ের সূচনা প্রকাশ করে।
কুনজি গুহা, খোররামাবাদ উপত্যকা
সভ্যতার রূপান্তরের প্রমাণ
উপত্যকাটি পাথরের যুগ থেকে লৌহ যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতার রূপান্তরের পূর্ণ চক্রের প্রমাণ বহন করে। আধুনিক কার্বন-১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে। এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখায়, কীভাবে নিয়ান্ডারথালদের স্থান দখল করে আধুনিক মানুষ এখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়া—মানব অভিবাসনের করিডোর
খোররামাবাদ উপত্যকা আফ্রিকা থেকে এশিয়া ও ইউরোপে মানব অভিবাসনের একটি কৌশলগত করিডোর হিসেবেও বিবেচিত। এখানকার গুহাগুলোতে পাওয়া মউস্টেরিয়ান ও বারাদোস্তীয় সংস্কৃতির নিদর্শন যা মানব বিবর্তনের এক অমূল্য দলিল। এখানে আধুনিক মানুষ এবং নিয়ান্ডারথালদের উপস্থিতি, তাদের হাতিয়ার ব্যবহারের ধরণ ও বসতির ধরন থেকে বোঝা যায়- কীভাবে মানুষ বিকশিত হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে এবং একটি বৈশ্বিক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
গামারি গুহা, খোররামাবাদ উপত্যকা
সংস্কৃতির ভাষায় লেখা প্রত্নতত্ত্বের গৌরব
২০০৭ সাল থেকে ইউনেসকোর অস্থায়ী তালিকায় থাকা এই উপত্যকা ২০২৩ সালের শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হয়। এরপর ২০২৪ সালে মাঠ পর্যায়ের পরিদর্শন এবং ২০২৫ সালের জুনে আন্তর্জাতিক স্মৃতিসৌধ ও প্রত্নস্থল পরিষদ (আইসিওএমওএস) -এর ইতিবাচক মতামতের পর, ১০ জুলাই ২০২৫-এ আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত হয়।
ইরানের সংস্কৃতি, পর্যটন ও হস্তশিল্পমন্ত্রী সাইয়েদ রেজা সালেহি আমিরি এই তালিকাভুক্তিকে এক ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায়, “খোররামাবাদ উপত্যকা শুধুমাত্র একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব বসতিগুলোর একটি। আমাদের মাটি, আমাদের পাথর, আমাদের স্তরবিন্যাস আজ ইতিহাসের ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ”
তিনি আরও বলেন, “এই স্বীকৃতি শুধু ইরানের নয়—পুরো মানবজাতির এক অর্জন। কারণ এই উপত্যকা দেখিয়েছে, মানুষ কেবল যুদ্ধ ও রাজনীতির ইতিহাস নয়, বরং সৃষ্টির ইতিহাসও বহন করে। ”
সংস্কৃতির ধ্বনি বনাম যুদ্ধের শব্দ
বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে এই স্বীকৃতি এক অনন্য বার্তা বহন করে। সালেহি আমিরি বলেন, যখন ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের জাতিগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলছে, তখন ইরান বেছে নিচ্ছে বিস্ফোরণের শব্দ নয়—সংস্কৃতির ধ্বনি শোনানোর পথ।
এই বক্তব্য নিছকই রাজনৈতিক নয়—এটি ইরানের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার এক কৌশল। ইতিহাস, শিল্প, মানব সভ্যতার স্মৃতি রক্ষা করে ইরান দেখাতে চায়—তাদের শক্তি শুধু প্রতিরোধে নয়, তাদের শিকড় বহু গভীরে।
লোরেস্তানের গভর্নর জেনারেল সাইয়েদ সাঈদ শাহরুখি (মাঝে)
এক জীবন্ত জাদুঘর: মানব ইতিহাসের পূর্ণ চক্র
খোররামাবাদ উপত্যকা পাথরের যুগ থেকে লৌহ যুগ পর্যন্ত মানুষের রূপান্তরকে দলিল করে রেখেছে। এখানে পাওয়া প্রতিটি নিদর্শন—হোক তা একটি কাঁচা পাথরের ছুরির ফলা, না হয় কয়লার দাগে আঁকা একটি রেখা—একেকটি বাক্য মানবজাতির আত্মজিজ্ঞাসার।
ইরানের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক উপমন্ত্রী আলী দারাবি এ সম্পর্কে বলেছেন, এই স্থানটি ৬৫ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার দলিল। এখান থেকে আমরা শিখি মানুষ কীভাবে চিন্তা করেছে, ভয় পেয়েছে, ভালোবেসেছে, আর ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে।
লোরেস্তান প্রদেশের গভর্নর-জেনারেল সাইয়েদ সাঈদ শাহরুখি এই অর্জনকে খোররামাবাদের জনগণের জন্য ‘একটি সম্মানের মুহূর্ত’ হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, “লোরেস্তানে ৫,০০০-এরও বেশি প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যার ১৪টি কেবল এই উপত্যকার মধ্যেই। ”
ইরানের ঐতিহ্য বিশ্বে পরিচয়ের সেতু
বর্তমানে ইরান ইউনেসকোর তালিকায় ২৯টি দৃশ্যমান ও প্রাকৃতিক নিদর্শন ও ২৬টি অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত করেছে—যার ফলে দেশটি এই ক্ষেত্রে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী ৫০ বছর ধরে প্রতি বছর অন্তত একটি নতুন নিদর্শন এভাবে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হবে।
তবে এই তালিকাভুক্তির বাইরে থেকে গেছে ফলক-আল-আফলাক দুর্গ। মন্ত্রী জানান, সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতা দূর করে আগামী বছর এই দুর্গও খোররামাবাদ উপত্যকার অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারে।
পাথরের নিঃশব্দ ভাষায় লেখা এক ইতিহাস
খোররামাবাদ উপত্যকা এখন আর শুধু ইরানের এক নিভৃত অঞ্চল নয়—এটি বিশ্বমানচিত্রে সেই স্থান, যেখানে মানব সভ্যতার প্রথম স্বপ্ন, প্রথম ভয় আর প্রথম শিল্পরস সংরক্ষিত আছে। ইরান এ অর্জনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে—তাদের পরিচয় শুধু জ্বালানি বা ভূরাজনীতিতে নয়, বরং ইতিহাসের গভীরতম স্তরে, সেইসব গুহায় যেখানে আজও অনুরণিত হয় প্রাচীন নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি।
আরএইচ