ঢাকা, সোমবার, ৩ ভাদ্র ১৪৩২, ১৮ আগস্ট ২০২৫, ২৩ সফর ১৪৪৭

ফিচার

চোগা জানবিল: মরুভূমির বুকে প্রাচীন সভ্যতার আকাশছোঁয়া স্মৃতি

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:১৮, আগস্ট ১৮, ২০২৫
চোগা জানবিল: মরুভূমির বুকে প্রাচীন সভ্যতার আকাশছোঁয়া স্মৃতি চোগা জানবিল জিগুরাত: মাটির সমতল থেকে নেওয়া দৃশ্য

সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র উপাদানে সমৃদ্ধ দেশ ইরান। দেশটির শিল্প-ঐতিহ্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, সমৃদ্ধ ও সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী।

ইরান মানেই কেবল পারস্য সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য বা ইসলামি শিল্পের ঝলক নয়, বরং আরও গভীরে আছে বহু সভ্যতার উত্তরাধিকার। তারই একটি উজ্জ্বল উদাহরণ ‘চোগা জানবিল জিগুরাত’।

দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের শূন্য মরুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন জিগুরাত (পিরামিড সদৃশ মন্দির) যেন সময়ের সীমানা ভেঙে আজও অতীতের গল্প শোনায়। রহস্যময় এই স্থাপনা ১৯৭৯ সালে ইরানের প্রথম ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।


চোগা জানবিল জিগুরাত পুর্ননির্মাণের থ্রি-ডি ছবি

জিগুরাত—আকাশের সিঁড়ি

খুজেস্তানের শুশ অঞ্চলে ৩ হাজার বছরেরও বেশি আগে নির্মিত ‘চোগা জানবিল’ মন্দিরটি ‘চোগা জানবিল জিগুরাত’ নামেও পরিচিত। ‘জিগুরাত’ মানে হলো ধাপে ধাপে উঁচু করা মন্দির বা পিরামিড-সদৃশ স্থাপনা, যা আকাশের দিকে উঁচু হয়ে উঠত। ‘জিগুরাত’—শব্দটি উচ্চারণ করলেই মনে হয় যেন আকাশছোঁয়া কোনো প্রাচীন মন্ত্র ভেসে আসছে। এই শব্দের মূল আক্কাদীয় ভাষা, যার অর্থ—‘উঁচু করা’, ‘আকাশের দিকে উঠিয়ে দেওয়া’ ইত্যাদি। মেসোপটেমিয়া থেকে ইলাম—যেখানে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেখানে ‘জিগুরাত’ মানে ছিল দেবতার কাছে পৌঁছানোর সিঁড়ি, আকাশ আর মাটির সংযোগ সেতু। ধাপে ধাপে ওঠা এক বিশাল স্থাপনা, যা পৃথিবীর বুক থেকে আকাশের দিকে প্রসারিত।


কাঁচা ও পোড়া ইট দিয়ে নির্মিত হয় চোগা জানবিল মন্দির

চোগা জানবিলের ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২৫০ সালে ইলামি রাজা ‘উনতাশ নাপিরিশা’-এর শাসনামলে ‘চোগা জানবিল জিগুরাত’ নির্মিত হয়। ‘দুর-উনতাশ’ শহরে (যা তখনকার ইলাম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল) এটি নির্মিত হয় এবং শুশ নগরীর কথিত রক্ষাকর্তা দেবতা ইনশুশিনাক-এর উপাসনার জন্য উৎসর্গ করা হয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে নির্মিত এই জিগুরাতকে ইলামি ধর্মীয় স্থাপত্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়।

কেবল একটি মন্দির নয়, পুরো শহরটি ছিল রাজকীয় স্বপ্নের প্রতিফলন। ভেতরে ছিল অজস্র উপাসনালয়, আবাসস্থল, প্রাসাদ এবং প্রতিরক্ষার জন্য তিন স্তরের প্রাচীর। শহরটি ছিল যেন এক পবিত্র দুর্গ—যেখানে ধর্ম আর রাজনীতি একই সূত্রে বাঁধা ছিল।


জিগুরাতের দেওয়ালে খোদাই করা কিউনিফর্ম লিপি

স্থাপত্যের বিস্ময়

চোগা জানবিল জিগুরাত ছিল অত্যন্ত নিখুঁত ও শৈল্পিক স্থাপনা। পাঁচতলা বিশিষ্ট, ১০৫ মিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ৫৩ মিটার উচ্চতার এই মন্দিরটি প্রাচীন যুগের অন্যতম উঁচু স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মূল উপাদান ছিল কাঁচা ইট ও পোড়া ইট।  জিগুরাতের প্রতিটি স্তর একটির উপর আরেকটি—ক্রমশ ক্ষুদ্র হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। প্রতিটি স্তর নিচের স্তরের চেয়ে ছোট ছিল, ফলে পুরো স্থাপনাটি এক বিশাল পিরামিড আকৃতির রূপ নেয়। কাঁচা ইট আর পোড়া ইটের মিশেলে গড়ে তোলা এই মহীরুহে ব্যবহৃত হয়েছে রঙিন গ্লেজ করা ইট এবং খোদাই করা কিউনিফর্ম লিপি। দেয়ালের প্রতিটি ইট যেন একেকটি ইতিহাসের পৃষ্ঠা, যেখানে লিখে রাখা আছে প্রাচীন মানুষের ধর্মবিশ্বাস, শিল্প আর জ্ঞানচর্চা।

এই ধর্মীয় নগরীকে ঘিরে ছিল বিস্তৃত জলাধার, যেখানে করুণ নদী থেকে কৃত্রিম খাল কেটে পানি আনা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকেই এমন প্রকৌশল ব্যবস্থা সত্যিই বিস্ময়কর।


অ্যাসিরিয়ানদের রাজা আশুর বানিপালের আদেশে ৬৪০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে চাগা জানবিল ধ্বংস হয়

ইতিহাসের অগ্নিপরীক্ষা

ইলামিদের সমৃদ্ধি খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আসিরীয় সম্রাটরা একাধিকবার ইরান আক্রমণ করে এই নগরী ধ্বংস করার চেষ্টা করে। ইলামের শেষ রাজা হুমবান হালতাশের সাথে যুদ্ধে অ্যাসিরিয়ানদের রাজা আশুর বানিপালের আদেশে ৬৪০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে চাগা জানবিল ধ্বংস হয়। তবুও সবকিছু মুছে যায়নি। মরুর বালুর নিচে ঘুমিয়ে ছিল ইতিহাসের এই অমূল্য ধন। বিশ শতকের মাঝামাঝি ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা খনন শুরু করলে আবার জেগে ওঠে এই নিস্তব্ধ নগরী। আজকের দিনে চোগা জানবিল দাঁড়িয়ে আছে ইরানের প্রথম ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে—১৯৭৯ সালে তালিকাভুক্ত হয়ে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের একটি শিলালিপিতে লেখা রয়েছে— “আমি সুসার জিগুরাত ভেঙেছি, যা ল্যাপিস লাজুলি পাথর দিয়ে চকচকে ইট দিয়ে তৈরি হয়েছিল... আমি ইলামের মন্দিরগুলোকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি... আমি সুসাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছি... মানুষের আহ্বান এবং সেখান থেকে আনন্দের কান্না আমার কাছে এসেছিল। ”

ইলামিদের অভিশাপ

চোগা জানবিলের অন্যতম রহস্যময় দিক হলো— এর সঙ্গে জড়িত তথাকথিত অভিশাপ। স্থাপনার ইটগুলোর ওপর ইলামি কিউনিফর্ম লিপিতে খোদাই করা শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘কেউ যদি এই পবিত্র স্থাপনাকে অপমান করে, ধ্বংস করে বা লুণ্ঠন করে, তবে তার ওপর দেবতাদের অভিশাপ নেমে আসবে’। এই শিলালিপিগুলো কেবল ইলামিদের গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, বরং প্রমাণ করে যে তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষার চেষ্টা করেছিল।

কিংবদন্তির ছোঁয়া

চোগা জানবিল শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ নয়, এর চারপাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য লোককাহিনি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, নগরীর ধ্বংস হওয়ার পেছনে রয়েছে দেবতার অভিশাপ। আবার কেউ কেউ বলেন, জিগুরাতের নিচে এখনো লুকিয়ে আছে অমূল্য ধন, যা অভিশাপের কারণে কেউ খুঁজে বের করতে পারে না।

আরেকটি গল্প আছে—রাজা ‘উনতাশ নাপিরিশা’ স্বপ্নে দেবতার নির্দেশ পান, তারপরই তিনি এই জিগুরাত নির্মাণে হাত দেন। সেই স্বপ্নের আহ্বানই যেন আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

ভ্রমণকারীর চোখে চোগা জানবিল

খুজেস্তানের শুশ ও শুশতার ভ্রমণ প্রাচীন ইরানি সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাস জানার একটি অনন্য সুযোগ। এই সফরের অন্যতম আকর্ষণ হলো চোগা জানবিল জিগুরাত, যা শুশ নগরীর নিকটে অবস্থিত এবং ইলামি সভ্যতার স্থাপত্যকৌশল ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উজ্জ্বল নিদর্শন। ভ্রমণকারীরা এই পবিত্র স্থান দর্শনের মাধ্যমে অতীতের আভিজাত্য অনুভব করতে পারেন। শুশ ও শুশতার ভ্রমণ কেবল চোগা জানবিলেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আপাদানা প্রাসাদ ও শুশতার জলপ্রণালী ব্যবস্থার মতো বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শনও।

চোগা জানবিল আজ শুধু ইরানের নয়, পুরো মানবজাতির উত্তরাধিকার। এখানে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়েছে—ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান আর স্থাপত্যের মিলনে তৈরি করেছে আকাশছোঁয়া স্মৃতি।

১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে চোগা জানবিল বিশ্ববাসীর কাছে ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক প্রতীক। পৃথিবী তখন স্বীকার করে নেয়—ইলামি সভ্যতা কোনো বিস্মৃত কাহিনি নয়, বরং মানবজাতির সম্মিলিত ইতিহাসের অংশ।

এখানে দাঁড়ালে বোঝা যায়—মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই আকাশ ছুঁতে চেয়েছে। ধর্ম, শিল্প, স্থাপত্য ও স্বপ্ন—সবকিছুর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এই আকাশছোঁয়া স্মৃতি। ধ্বংসস্তূপ হয়েও চোগা জানবিল আজ অমর, সময়ের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্ত যাত্রার প্রতীক হয়ে।

খুজেস্তানের পথে যদি কখনো আপনার যাওয়া হয়, অবশ্যই একটু থামবেন এই নিস্তব্ধ নগরীতে। তখন হয়তো বুঝতে পারবেন, সময় সবকিছু মুছে দেয় না—কিছু কিছু গল্প অমর হয়ে থাকে, বাতাসে, ইট-পাথরে, কিংবা ভ্রমণকারীর হৃদয়ে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।