ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

পাখিদের তিন বাড়ি

তমাল ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০২ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১০
পাখিদের তিন বাড়ি

রাতদিন শুধু পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ। সাঁ সাঁ শব্দে ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নোঙর করে পাখিবাড়িগুলোর গাছের ডালে, পুকুরের জলে, বাড়ির আঙিনায়।

পাখিদের মধুর সুরে ভরে উঠে বাড়ির পরিবেশ। খুব ভোরে খাদ্যের সন্ধানে চলে যায় ওরা। আবার অনেকে থেকে যায় বাড়িগুলোতেই। কেউ পাখিদের স্পর্শ করে না, বকাও দেয় না। সবাই ওদের পরিবারের সদস্য মনে করে আদর করে, খেলা করে। এসব দৃশ্য নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর, বড়লেখা ও শ্রীমঙ্গলÑ এ তিন উপজেলার তিনটি গ্রামে তিনটি বাড়ি ‘পাখিবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। রাজনগরের হরিপাশা গ্রামের আরক আলী, বড়লেখার সালদিঘা গ্রামের বরহুম মিয়া এবং শ্রীমঙ্গলের লইয়ারকুল গ্রামের মৃত ঠাকুর মিয়ার বাড়ি রাত-দিন মুখর থাকে পাখিদের কলরবে। বাড়ি তিনটি যেন পুরো জেলার সব বাড়ি থেকেই একটু অন্যরকম।  

রাজনগরের পাখিবাড়ি

রাজনগর উপজেলার হরিপাশা গ্রামের আরক আলী ‘পাখিবান্ধব’ হিসেবে ইতিমধ্যে সিলেট অঞ্চলে পরিচিতি লাভ করেছেন। কেউ কেউ আবার আরক আলীকে ‘পাখি-জাদুকর’ হিসেবেও চেনে। তার বসতবাড়িটিকেও ‘পাখিবাড়ি’ নামেই সবাই জানে। বছরজুড়ে হাজার-হাজার পাখিতে মুখর থাকে তার বাড়ি। স্বাধীনতার পর থেকে তার বাড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। প্রথম দিকে বিরক্ত হতো তার পরিবার-সদস্যরা। তাই বাড়ির সব বাঁশঝাড় ও বড় গাছ কেটে ফেলেন আরক আলী। কিন্তু পাখিরা থামেনি, তারা আসতে থাকে। দিনে দিনে পাখিগুলোকে পরিবার- সদস্যরা নিজেদের সদস্য হিসেবেই মেনে নেন। মানুষ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি আর পাখিদের চমৎকার সহাবস্থান এই বাড়িতে। আরক আলী জানান, মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে পাখিরা আসে। এ সময় আগত পাখিরা ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটায়। বর্তমানে তার বাড়িতে সাদা বক ও কালো পানকৌড়িসহ ২৫-৩০ প্রজাতির ১০ থেকে ১২ হাজার পাখি রয়েছে। তিন শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির বড় গাছ এবং ২০-২২টি বাঁশঝাড়ে রয়েছে হাজার হাজার পাখির বাসা। বাড়ির বিভিন্ন গাছের ফলমূল পাখিদের খাবারের জন্য বরাদ্দ থাকে। কিছু পাখি সকালবেলা খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, বিকেল হলে ফিরে আসে আবাসস্থলে। কিন্তু সবচে অবাক করা ঘটনা হচ্ছে আরক আলীর প্রতিবেশীদের বাড়িতে বড় বড় গাছ থাকলেও কোনো পাখি ভুলেও সেদিকে পা বাড়ায় না। পাখিদের নিরাপত্তার জন্য তার বাড়িতে রয়েছে চারটি কুকুর। এগুলো বাড়িতে অপরিচিত লোকজন দেখলে এমনভাবে হইচই শুরু করে যে, অপরিচিত লোকজনের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পাখিপ্রেমী লোকজনকে সামর্থ্য অনুযায়ী আনন্দচিত্তে আপ্যায়ন করে থাকেন বাড়ির সদস্যরা।

বড়লেখার পাখিবাড়ি

বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা গ্রামের কৃষক বরহুম মিয়া। গ্রামের আর দশজন কৃষক থেকে তিনি যেন আলাদা। গত চার বছর ধরে তার বাড়িটি ‘পাখিবাড়ি’ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছে। হাকালুকি হাওরের পাখিরা তার বাড়িতে নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছে। বরহুম মিয়াও পাখিদের যতœ-আত্তি করা এবং শিকারিদের হাত থেকে পাখিদের রায় তৎপর। পাখিরা যেন তার সন্তানতুল্য। বরহুম মিয়া জানান, পাখির ডানা ঝাপটানো এবং কিচিরমিচির না শুনলে আমাদের যেন ঘুমই আসে না। তার বাড়িতে সারস, বক, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি বসবাস করে। বাড়ির কড়ই, জারুল, জাম, আম, কাঁঠাল গাছের ডালে ডালে পাখিদের সংসার। অপূর্ব দৃশ্য। বরহুম মিয়া পাখিদের বাড়ির সদস্যের মতই লালন-পালন করে থাকেন। প্রতিদিন ভোরে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে হাকালুকি হাওরে উড়ে যায় এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসে।

শ্রীমঙ্গলের পাখিবাড়ি

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে লইয়ারকুল গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে মৃত ঠাকুর মিয়ার বাড়িটি প্রায় সারা বছরই থাকে পাখিমুখর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন যখন ঘরে ফিরতে ব্যস্ত, তখনই হাজার হাজার পাখি এসে আশ্রয় নেয় বাড়ির পাঁচটি বৃহদাকার গাছে। নির্বিঘœ-নিরাপদ রাতযাপন শেষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই অজানার উদ্দেশে উড়ে যায় পাখিগুলো। পাখির নিরাপদ রাতযাপন নিশ্চিত করতে বাড়ির লোকজন পালা করে পাহারা দেয়। রাত যত গভীর হয় পাখিদের কিচিরমিচির ও ডানা ঝাপটানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়।


‘পাখিবাড়ির’ মালিক মৃত ঠাকুর মিয়ার পুত্র আবদুস শহীদ জানালেন, আমার বাবা ঠাকুর মিয়ার পাখি পোষার শুরুটা আমার জানা নেই। তবে মায়ের কাছে শুনেছি তিনি পাখিদের সাথে খেলাধুলা করতেন, রাত জেগে পাখিদের পাহারা দিতেন। আমরাও এখন বাবার মতো পালাক্রমে রাত জেগে পাখিদের পাহারা দেই। বালিজুড়ি, কানিবক, সাদাবক, লালবকসহ গত মে মাস থেকে আগত পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পানকৌড়ি আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে। এরপর থেকেই বাড়িটি ‘পাখিবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।


প্রাণী সংরণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব বলেন, আরক আলীর পরিবার, বরহুম মিয়ার পরিবার এবং ঠাকুর মিয়ার পরিবার এ দেশের জীববৈচিত্র্য রায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জীববৈচিত্র্য রায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ সহযোগিতার হাত বাড়ালে পরিবেশ ভারসাম্য রার পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের ত্রেও প্রসারিত হবে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় : ১২৩৫, জুলাই ০৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।