‘মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে রাজশাহীর আম না পাঠালে বেয়াই-বিয়াইন কথাই বলবে না’- হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন নাটোর থেকে আম কিনতে আসা জমির উদ্দিন। হেসে বললেও এটা এ অঞ্চলের আলিখিত প্রথা।
রাজশাহী বিভাগে আমের ফলন এবং স্বাদ বেশি হওয়ার কারণে রাজশাহীকেই আমের রাজধানী ধরা হয় । আমের মৌসুমে আমের রাজধানীতে আমের বাজার কেমন হয় তা জানার কৌতূহল আছে অনেকের । আর এজন্যই আসি আমের এ বাজারে ।
দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে। তার পরের বাজার রাজশাহীর বানেশ্বরে। রাজশাহীতে ঢোকার আগের স্টপেজ বানেশ্বর, এখানেই সরাসরি নামি বাস থেকে। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে আড়মোড়া দিয়ে জাগতে শুরু করে আমের বাজার। নিমিষের মধ্যে দেখি মানুষ এবং আমে ভরে যাচ্ছে বাজার। বড় ব্যবসায়ীরা পাশের শহরগুলো থেকে ট্রাকে করে, দূর গ্রাম থেকে ভ্যানে ওপর ঝুড়িতে করে, কেউ কাছের গ্রাম থেকে বাইসাইকেলের দুই পাশে দুই ঝুড়ি ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটে, কেউ দুই কাঁধে দুই ঝুড়ি নিয়ে, কেউ আবার ঝুড়ি মাথায় করে নিয়ে আসছেন নানা রকম আম।
সাদা বেতের ঝুড়িতে এত হলুদ-সবুজ আম দেখে মন ভালো হয়ে যায়। আমের বোঁটা থেকে সাদা কষ ঝরে পড়া দেখে বোঝা যায় এখানের আমে রাসায়নিকের ব্যবহার নেই। মূল সড়কের দু পাশে খুচরা ব্যবসায়ীরা আম সাজিয়ে বসেছেন। কেউ মাটির ওপর ঝুড়িতে, আবার কেউ ভ্যানের ওপর ঝুড়িতে করে বিক্রি করছেন আম। আবার তার পেছনের সারিতে ঘরের ভেতর রয়েছে পাইকারি বিক্রির জন্য অঢেল আম ।
আম কত করে মণ আপনারা কেনেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্যবসায়ী রহিম শেখ বলেন ‘আম কিনে আম বিক্রিতে লাভ নেই, তাই আমি কিনি আমের পাতা, মাঝেমধ্যে মুকুলও কিনি। ’ কথাগুলো শুনে কেমন যেন লাগল। বিস্তরিত কথা বলে জানলাম, তিনি আম ধরার আগেই আমের বাগান কেনেন সেক্ষেত্রে পরে যদি আম না ধরে তবে তাকে আমের পাতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়; আবার ফলন বেশি হলে লাভ তারই। অধিকাংশ বড় ব্যবসায়ীরা এভাবেই আম কেনেন।
নদীর মতো মানুষ ছুটে আসছে আম নিয়ে বানেশ্বরের এ বাজারে । যেন এটি আমের সমুদ্র এক! লম্বায় এ বাজার প্রায় মাইলখানেক। যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থার কারনে ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ এখানে আসে আম কিনতে। সারা দিনই মানুষের সমাগম। চলছে ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষি, আবার এখানে বসেই ক্রেতারা আম খাচ্ছেন স্বাদ পরীক্ষার জন্য। কেউ এক মনে বসে বুনছেন নানা আকৃতির আমের ঝুড়ি। এত কোলাহলের মাঝেও আমের মিষ্টি গন্ধে মন ভালো হয়ে যায়; চোখ শান্তি পায় এত সবুজ আর এত আম একসাথে দেখে।
নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষও এখানে আসেন আম বিক্রি করতে। ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই আম কিনে সারা দেশে বিক্রি করেন । সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে এ বাজারে। এখন আস্তে আস্তে আমের ঋতু শেষ হয়ে আসছে। বৈচিত্র্যও কমে আসছে। তারপরও প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মণ আম বিক্রি হয়। তবে এখানে ৪৫ থেকে ৪৮ কেজিতে মণ ধরা হয় । বর্তমানে আমের দাম একটু বেশি। লেংরা এবং খিরসা আম তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও তা ৩৮০০ টাকা থেকে ৪২০০ টাকা প্রতি মণ। খুচরা কিনতে গেলে দাম পড়ে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। তাই মণ হিসেবে কেনাই লাভ। আর এভাবে বেশি বিক্রি হয়। বর্তমান বাজার ভরে আছে বোম্বাই এবং ফজলি আমে। এসব আম ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা মণে বিক্রি হয়। আর কদিন পরেই আসবে আশ্বিনা আম।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রহমত আলী ‘কেমন ব্যবসা হচ্ছে’ এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘এ সময়টা আমাদের কাছে ঈদের মতো। তবে দালালদের কারণে ব্যবসায় কিছু কম লাভ হয়। ’ আসলে দালালরা মাঝখানে থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকেই টুপাইস কামিয়ে নেয়। কিন্তু এর প্রভাব বেশি পড়ে ব্যবসায়ীদের ওপর।
এখানকার একটি রেওয়াজ হলো, এ সময়ে এ অঞ্চলে করো বাড়িতে কেউ এলে তাকে আম দিয়ে আপ্যায়ন করানো। তেমনি এ ব্যবসায়ীও আমাকে আম খাওয়ালেন। সে স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬০৫, জুলাই ০৯, ২০১০