ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

ম্যান্ডেলার জন্য ভালোবাসা

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১০
ম্যান্ডেলার জন্য ভালোবাসা

‘নেতৃত্বদানের জন্য তোমাকে থাকতে হবে পেছনে এবং অন্যদের রাখতে হবে সামনে। বিশেষ করে বিজয় উৎসব ও সুন্দর ঘটনার সময় তোমার পেছনে থাকাই ভালো।

তবে বিপজ্জনক মুহূর্তে তোমাকে অবশ্যই সামনে অবস্থান নিতে হবে। তাহলে জনগণ তোমার নেতৃত্বের প্রশংসা করবে। ’

ওপরের এই উক্তিটি যার, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা, কালো মানুষের মুক্তির অন্যতম নায়ক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। সারা জীবন তিনি তার ওই উক্তির মতোই জনগণের বিপজ্জনক মহূর্তে এগিয়ে এসেছেন সামনের সারিতে। প্রশংসিত হয়েছেন আফ্রিকার সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের জনগণের। তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী আদর্শ।

২০০৮ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত। ওই বছরই পালিত হয় তার ৯০তম জন্মদিন। ওই বছর শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র তাকে মহৎ নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

আজ ১৮ জুলাই এই মহান নেতার ৯২তম জন্মদিন। জাতিসংঘ দিনটিকে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। গত বছর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। জাতিসংঘের ১৯২ সদস্য মহাসচিবের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। জাতিসংঘ এ বছর দিনটিতে সাধারণ পরিষদের অনানুষ্ঠানিক অধিবেশনে ‘ম্যান্ডেলা সন অব আফ্রিকা: ফাদার অব দ্য ন্যাশন’ নামের চলচ্চিত্র দেখাবে। আয়োজন করা হবে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা: ম্যান অব পিপল’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। কিউবা সরকার ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে ১৮ জুলাই তাদের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের এক আদিবাসী গোত্রে মাভেজো ইউনিয়নে  নেলসন ম্যান্ডেলা জন্মগ্রহণ করেন। তার গোত্রীয় নাম দালিভুংগা ম্যান্ডেলা। পরে স্কুলের এক শিক্ষকের কাছ থেকে পান তার ইংরেজি নাম     ‘নেলসন’।

বাবার মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন গ্রামে বেশ ভালোই কাটছিল। ১৯২৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর তার দেখাশোনার ভার পরে থেম্বু গোত্রের রাজপ্রতিভু এক আত্মীয় সর্দার জনগিনটাবার কাছে। কিন্তু কৈশোরোত্তীর্ণ হওয়ার পর ম্যান্ডেলা গোত্রের আইনের বেড়াজালে আটকে পড়েন। বিয়ে করার ইচ্ছে না থাকলেও প্রথার কারণে জোর করে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হলে পালিয়ে যান বিয়ের আসর থেকে জোহানেসবার্গে। সেখানেই শিক্ষানবিশ হিসেবে একটি আইন প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি অনেক ধরনের কাজই করেছেন।

ম্যান্ডেলার কর্মজীবন বেশ বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন রাখাল, মিশনবয়, খনি পুলিশ, ল ফার্মের কেরানি, মুষ্টিযোদ্ধা, আইনজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, গেরিলা যোদ্ধা, বিপ্লবী নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক।
জোহানেসবার্গেই ম্যান্ডেলা প্রথম লক্ষ করেন কালো মানুষদের গণ্য করা হচ্ছে না মানুষ হিসেবে, তাদের প্রতিনিয়তই বঞ্চিত করা হচ্ছে ন্যায্য অধিকার থেকে। দেশের বেশির ভাগ সম্পদই জিম্মি হয়ে আছে গুটিকয় শ্বেতাঙ্গদের হাতে।

১৯৪৩ সালে তিনি এক সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগ দিলেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে বা এএনসিতে। কিন্তু বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এএনসির  কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ম্যান্ডেলা ১৯৪৪ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অলিভার ট্যাম্বো ও ওয়াল্টার সিসুলকে নিয়ে এএনসির যুবদল গঠন করেন। চলতি আইনকানুনের বিরুদ্ধে শুরু করেন অহিংস আন্দোলন। ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে মামলা করা হয় ম্যান্ডেলাসহ ১৫৫ জন রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে। ১৯৬০ সালে কালোদের অধিকার খর্ব করে এমন একটি আইনের প্রতিবাদ করায় নারী-পুরুষ ও পুলিশের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে মারা যায় ৬৯ জন। এএনসিকে নিষিদ্ধ করা হয়।

৫ বছর মামলা চলার পর ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকে প্রত্যেককে মুক্তি দেওয়া হলেও ম্যান্ডেলা পালিয়ে থাকেন। তার ওপর তখনও ছিল হুলিয়া। ওই অবস্থায়ই তিনি দেশজুড়ে কর্মীদের সংগঠিত করেছেন। ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করে আফ্রিকার নানা দেশ সফর করেছেন। ওই সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকে এএনসির জন্য সমর্থন ও অর্থ সংগ্রহ করেছেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে গুপ্ত সামরিক বাহিনী গঠন করেন।

১৭ মাস আত্মগোপন থাকার পর দেশে ফিরলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট। ১৯৬৪ সালে তাকে আজীবন কারাদ- দিয়ে পাঠানো হয় রোবেন দ্বীপে। বন্দিজীবনে বর্ণবাদী সরকারের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব পেয়েছেন অনেকবার, কিন্তু প্রতিনিয়তই তা তিনি প্রত্যাখান করেছেন। আপস করে দুর্বিসহ কারাজীবন থেকে তিনি মুক্তি নেননি।

১৯৬৮ সালে তার মায়ের মৃত্যু হয় এবং ১৯৬৯ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় তার ছোট ছেলে। কিন্তু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়নি তাকে কারা কর্তৃপক্ষ। তবু আত্মজীবনীতে কারাজীবনের রোবেন দ্বীপের কারাগারটিকেই তিনি পরে আখ্যা দিয়েছেন তার জীবনের বিশ্ববিদ্যালয় (রোবেন ইউনিভার্সিটি) বলে। এই কারাজীবনে থাকাকালেই নেতা হিসেবে নিজস্ব কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছান ম্যান্ডেলা, যার প্রয়োগ দেখা যায় তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকা- ও জীবনযাপনে।

দীর্ঘ ২৭ বছর জেল খাটার পর ম্যান্ডেলা ছাড়া পান ১৯৯০ সালে, সেই সাথে উঠে যায় তার দল এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা। তিনি সারা পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন এবং স্বীকৃত হন মানুষের অধিকারের জন্য আত্মত্যাগকারী একজন বিশ্বনেতা হিসেবে। কিন্তু যে শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকার জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছে তিনি তাদের বিরুদ্ধে সহিংস পন্থা থেকে সরে আসেন। বরং ‘শ্বেতাঙ্গ’ এবং ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ নামে বর্ণবাদী চিন্তাচেতনায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানসিকতাকে ম্যান্ডেলা একত্র করে ফেলেন নিজ প্রজ্ঞাবলে। পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেন। এই কৃতিত্বের জন্য ১৯৯৩ সালে ম্যান্ডেলাকে ডি কার্কের সঙ্গে যুগ্মভাবে প্রদান করা হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।

১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো পৃথিবীতে ঘটে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ম্যান্ডেলার দল নির্বাচনে জয় লাভ করল। তিনি হলেন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করে পরে স্বেচ্ছায়ই ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তিনি আর নির্বাচনে অংশ নেননি। ওই সময় অনেকেরই ধারণা ছিল, ম্যান্ডেলা বুঝি ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার মোহে পড়ে আর কখনই তার ক্ষমতা ছাড়বেন না, কিন্তু তিনি এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে পুরোপুরি সরে আসেন।

সম্প্রতি ম্যান্ডেলার দেশেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বকাপ ফুটবল। দক্ষিণ আফ্রিকা এবারের বিশ্বকাপ ভেন্যু নির্বাচিত হওয়ারও নেপথ্যে ছিল তারই সবচে বড় ভূমিকা। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী জানল এক নতুন আফ্রিকাকে, ম্যান্ডেলার মাতৃভূমিকে। অনেকেরই ধারণা ছিল তিনি আসবেন এই বিশাল আয়োজনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিন্তু আচমকা দুর্ঘটনায় তার প্রিয় নাতনির মৃত্যুতে তিনি আসতে পারেননি। সেদিন বিশ্বকাপ উৎসবের বিপরীতে ম্যান্ডেলার নাতনির মৃত্যুর বেদনা ছুঁয়ে গিয়েছিল সবাইকে।

ম্যান্ডেলা অবশ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না আসতে পারলেও, এসেছিলেন ফাইনাল খেলার দিন। সেদিন খেলার পাশাপাশি তার উপস্থিতিও দর্শকদের ভিন্ন এক আনন্দময় অনুভূতি দিয়েছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে জাতিসংঘ ও ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেসনসহ সারা বিশ্বই নানা রকমের আলোচনা ও উৎসবের আয়োজন করেছে। কিন্তু ম্যান্ডেলা আছেন তার আপন জগতে, নিজের মতোই সহজ ও অনাড়ম্বর। তার জন্মদিনটি তিনি পরিবারের সঙ্গেই কাটাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৯২ বছরে পা দেওয়া নেলসন ম্যান্ডেলা হয়তো শারীরিকভাবে পৃথিবীতে বেশি দিন থাকবেন না আর। কিন্তু তার সংগ্রাম, স্বপ্ন ও সাধনা পৃথিবীতে সপ্রাণ থাকবে চিরকাল। কারণ ম্যান্ডেলা কেবল একজন ব্যক্তিমাত্র নন আর, তিনি হয়ে উঠেছেন এক মহান ইতিহাস, যা মানুষকে মুক্তি ও শান্তির স্বপ্ন দেখাবে বহু বহুকাল।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০১০, জুলাই ১৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।