ভরা মৌসুমে প্রমত্তা পদ্মার পাড় ভাঙছে বেয়াড়া স্রোতে। বিলীন হচ্ছে গাছপালা, স্কুল, ঘর-বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম।
পদ্মার বুক ঘুরে: আমাদের দেশে একটি অন্যতম সামাজিক ব্যাধি বাল্যবিয়ে। এটি প্রতিরোধে সরকার যখন নানামুখি কার্যক্রম গ্রহণে ও তা বাস্তবায়নে তৎপর, ঠিক এমন সময় পদ্মাপাড়ের নদীভাঙা মানুষগুলো হাঁটছে উল্টোপথে । তাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এখনো রয়েই গেছে।
শিবালয় থেকে মাওয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পদ্মার ভয়াল রূপ। এ ভয়াল রূপের সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে বাল্যবিয়ে নামেরে এক সামাজিক ব্যাধি। বাংলানিউজের বিশেষ এই ‘অভিযান’ পরিচালনা করা না হলে গণমাধ্যমে পদ্মাপাড়ের এই ব্যাধির কথা অজানাই থেকে যেত বলে মনে করেন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার দড়িকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য।
তবে এ বিষয়টি নিয়ে যখন তিনি কথা বলছেন, তখন শর্ত জুড়ে দিলেন: ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’।
তার নাম প্রকাশ করা না গেলেও যা তিনি বললেন তা রীতিমতো ভয়ংকর। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এ-বছরের জানুয়ারিতে এ এলাকার এক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। ওই মেয়ের বয়স মাত্র ১২! যার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে সে লোকের বয়স ৪০/৪২ এর মতো। সে লোকের আবার দ্বিতীয় বিয়ে।
তিনি বলেন, বিয়ের পরদিন সে মেয়েটি পালিয়ে চলে আসে তার বাবার বাড়ি। ওই মেয়েটিকে পড়া থেকে ছাড়িয়ে বিয়ে দেওয়া হয়। সে আবার স্কুলে যেতে চায়, স্বামীর বাড়ি নয়। এ নিয়ে অনেক দেন-দরবার করে আমরা যারা এলাকার গণমান্য ব্যক্তিরা আছি, চেষ্টা চালিয়ে যাই। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কাজ হয়নি তাতে।
ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার বলেন, ওই মেয়েটি একটি মাদ্রসায় পড়তো। এ বছর পদ্মার প্রবল ভাঙনে মাদ্রাসাঘরটি ভেঙে যাওয়ার আগে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে সে জায়গায়টি নদীর পানি বাড়ার সাথে সাথে ভেঙে তলিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এরপর মাস দুয়েক আগে মেয়েটির বাবার বাড়িও ভেঙেছে নদীভাঙনে। শেষে বাধ্য হয়েই স্বামীর বাড়িই যেতে হয়েছে ওকে।
তিনি বলেন, এখন ওই মেয়েটির বাবা মা ও ভাই-বোন নদীভাঙনে গৃহহীন। আশ্রয় নেই কোনো। তারা নিজেরাই খেতে পান না। আর ঘরে মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে দূরের স্কুল-মাদ্রাসায় কী করে পড়াবেন! এটা কি সম্ভব!
তিনি বলেন, সময় পাল্টেছে। তবে পদ্মাপাড়ে সময় যেন থমকে আছে। এখানে নদীভাঙা ঘরে সামান্য শিশুকাল পার করা কিশোরী মেয়ে মানেই পরিবারের বোঝা।
এই তথ্যগুলো গা শিউরে ওঠার মতো হলেও রূঢ় বাস্তব। বাস্তব পদ্মাপাড়ের জন্য। নদীভাঙাদের জন্য।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার নয়াকান্দি, মান্দ্রাখোলা, গবিনাথপুর, উজানপাড়া, দড়িকান্দি, বকচর।
তার পাশে ঢাকার দোহার উপজেলার পানকুণ্ডু, দোয়ার বাজার, বাহ্রাঘাট বাজার, নারিশা, পশ্চিমপাড় চর, রাণীপুর মেঘলা বাজার, মধুপুর, বিলাশপুর। এরপর আরো পশ্চিমে এগিয়ে গেলে মুন্সীগঞ্জের মাওয়াঘাটের আগ পর্যন্ত।
পদ্মার যেখানেই ভাঙন সেখানেই বাল্যবিয়ের প্রবণতা। এতে ওই অঞ্চলের মানুষ কেবল গৃহহীন, সম্বলহীন, কর্মহীন কিংবা শিক্ষাহীনই হননি বেঁচে থেকেও হারিয়েছেন মানুষ হওয়ার অধিকার!
বাল্যবিয়ের ফলে ঘরে ঘরে নারীস্বাস্থ্য, শিশুপুষ্টি, মা ও শিশুর মানসিক সুস্থতা ও বিকাশ --সবকিছুরই পথ বন্ধ।
এছাড়া মানুষগুলোর আর কীই বা করার আছে এখানে। গ্রামের স্কুল-মাদ্রাসা নদীতে ভেঙে যায়, কই পড়তে দেবে শিশুদের? নিজের বাড়ি ভেঙে যায়, কই থাকতে দেবে ওই মেয়ে শিশুটিকে? নিজেদেরই নিরাপত্তা নেই, নিরাপদ আবাস নেই, কি করে নিরাপত্তা দেবেন ওই মেয়ে শিশুকে?
পদ্মাপাড়ের ওই মানুষগুলোর এসব প্রশ্নের উত্তর কি আছে কারো কাছে? একটাবার কি সরকার, প্রশাসন কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে কেউ কি এগিয়ে আসার মতো নেই এখানে? তীব্র ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার মান্দ্রাখোলা এলাকার মো. আয়নাল খাঁ।
মো. আয়নাল খাঁ মান্দ্রাখোলা এলাকায় এ-বছরে নদী ভাঙাদের একজন। তিনিও নিজের ছোট মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে। তার আরো ৪ মেয়ে ছিল। তাদেরও বিভিন্ন সময় কম বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমার বাড়ি পদ্মা ভেঙেছে। থাকার জায়গা এভাবে হারিয়েছি জীবনে তিন তিনবার। আর পারি না। এবার অন্যের জায়গায় উঠেছি। নিজেরাই তো খেতে পারি না। মেয়েদের কি খাওয়াবো? তাই এখানে আমাদের মতো নদীভাঙা মানুষদের জন্য মেয়ে শিশুদের বিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। আমাদের জন্য বাল্যবিয়ে বলে কি আর কিছু আছে!
এতো সব সমস্যার কারণেই এখানে বাল্যবিয়ের অভিশাপ জাঁকিয়ে বসেছে। যার বাস্তব চিত্র কেবল প্রমত্তা নদীটির পাড়ে পাড়ে।
এ দীর্ঘ নদীপথের দুই পাড়জুড়ে পদ্মার করাল ভাঙন। এতে হাজার হাজার মানুষ যেমন বাস্তুহারা হয়েছে। আর এদিকে বাস্তুহারা ঘরে ঘরে মেয়ে শিশুরা এক রকম বোঝাই হয়ে উঠেছে।
দড়িকান্দি এলাকার প্রাথমিক স্কুল থেকে গত বছর (২০১৩) সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ ছাত্রী সোনিয়া আক্তার (১৩)। বর্তমানে সোনিয়া এম. এ. রাজ্জাক হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
তবে মেধাবী এ শিক্ষার্থীর জন্য দুঃসংবাদ। চলতি বছর নদীতে ঘর ভেঙেছে। তাই সোনিয়ার বাবা মেয়ের জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেছেন।
পেয়েও গেছেন পাত্র। বিয়েও পাকাপাকি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া একটি মেয়ের বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেছে! তবু কেউ কিছু বলছে না।
বাকিটা শোনা যাক সোনিয়ার নিজের মুখে:
বাংলানিউজকে সে জানায়, এ বছর শীতে বিয়ে দিয়ে দিবে বাপে। বলসে আর পড়ন লাগবো না। যদি মাস্টারে স্কুলের ফিস ছাড়া পরীক্ষা দিতে না দেয় তয়লে আর পড়নও লাগবো না।
সোনিয়া বলে, স্বামীর বাড়িত গিয়া পড়নের সুযোগ নাই। বাড়ির কাম-কাইজ নাকি বেশি। মায়ে তো তাই কইসে।
সোনিয়া বলে, আমাগো ঘর ভেঙেছে। তাও দুই সপ্তাহ হইসে। এখন নদী থেকে দূরে টিনের মাচা বানায়া সবাই উঠসি। ঘরে খাবার নাই গা। দূরে এক বসায় ঝিঁয়ের কাম কইরা চাল আনসে মা। এটা চাইর, পাস দিন আগে। শেষ ভাতও খাইসি তহন।
বাপে মাটি কাটা, মাছ ধরা কোনো কাজই নিয়মিত পায় না। নিজেগো নৌকাও নাই যে একা পদ্মায় নামবো। এখন মা খালি কান্দে। রাতে কান্দে বাপেও। আমার ছোডো আরো দুই ভাই বোইন আছে হেরা তো অবুঝ, তাই ক্ষুধায় কান্দে হেরাও।
মায়ে বলে, তুই লেহাপড়া করছিস বড় হয়ে একটা মানুষ হয়িস, আমগো মতো মুখ্খ না। আর আমি বলি, লেহাপড়া যেহানে শিখলাম সে স্কুলটাই তো এহন আর থাকসে না। আমার তো শিক্ষার পরিচয়ই নেই। তয় এটি কোন শিক্ষা আমাগো!
তাই বিয়ে হইলেই কি আর না হইলেই কি বলে সোনিয়া!
সোনিয়া আরো বলে, আমার বয়স কম বলে আমি কিছু বুঝি না তা হতে পারে না। আমিই ভালো বুঝি। বুঝশক্তি হবার পর থিকাই দেখতেছি প্রতি বছরই এলাকার কোনো না কোনো আপা, খালা, চাচা, চাচীদের ঘর ভেঙেছে। এবছর আমাগোও ঘর-জমি ভেইঙ্গা হইলো নদী। যেখানে আমার ঘর আছিল সেখানে এখন ১০০ ফুটের ওপর পানি। বাপে অহন থাকবার দিতে পারবো না তো আর কই জাইতাম স্বামীর ঘর ছাড়া!
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই দৌড় দিল সোনিয়া।
পাশে থাকা ওর বান্ধবী জান্নাতুল ফেরদৌস বলে উঠলো, সই কান্না আর ধরে রাখতে পারেনি। তাই বাড়ি চইলা গেলো। আপনি কিছু মনে করিয়েন না। আমাদের একটা দুঃখ তো আছেই। সঙ্গে বাবা-মার কান্না। এই সবই জীবনডারে খুব তিতা করে দিসে এই খেলার বয়সে।
বাংলানিউজকে জান্নাতুল ফেরদৌস আরো বলে, আমারও বিয়া ঠিক হইতাসে। পাত্র দেইহা যায়। জানি না কোন দিন বিয়া হইয়া চইলা যাই।
সে জানান, খুব মন খারাপ লাগে যখন এইসব বিষয় নিয়া ভাবি। তয় কিচ্ছু করার নাই। নদী ভেঙে যে অভাবে পড়সি। এর থেইকা মুক্তি আমাগো মতো মেয়েদের কেবল বিয়াই!
এ রকম বহু সোনিয়া, জান্নাতুল ও ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারের উল্লেখ করা অনেক মেয়েশিশু রয়েছেন পদ্মার পাড়ে পাড়ে। যাদের জন্য নেই কোনো আইন। নেই কোনো নিয়ম। তাই তো অবাধে চলছে তাদের জীবন। যে জীবন থেকেও তাদের নয়। কারণ তাদের পরিচয় যে নদীভাঙা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে শিশুর বিয়ে হচ্ছে। যা বাল্যবিয়ে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০থেকে ১৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার।
আর সেভ দ্য চিলড্রেন-প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ মেয়েশিশুর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাদের ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাদের শতকরা বর্তমান হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ।
তথ্য, জরিপ কিংবা হিসাবে যা-ই বলা হোক না কেন এ নদীভাঙা মানুষগুলো কি সব হিসাবের ঊর্ধ্বে? নয় তো তাদের নদীও ভাঙে কপালও ভাঙে আর অবৈধ বাল্যবিয়েও হয়ে যায়। কিন্তু চোখে পড়ে না কারো! পদ্মার ভাঙনে মানুষগুলোর আসল অপরাধটা তাহলে কি?-- এখন এ প্রশ্নই ঘুরে ফিরে জাগে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৪
ফিচার
পদ্মার ভয়াল রূপ
নদীভাঙা ঘরে ঘরে বাল্যবিয়ে!
সৈয়দ ইফতেখার আলম ও শফিক শামীম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
![নদীভাঙা ঘরে ঘরে বাল্যবিয়ে!](public/uploads/2014/09/05/BG_543706811.jpg)
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।