বান্দরবান: বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে শুরু হয়েছে জুম কাটার ভরা মৌসুম। পাহাড়ি জুমের বাহারি ফসল তুলতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার স্থানীয় জুম চাষীরা।
জুমচাষীদের মুখে ফুটেছে নির্মল হাসি। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর জুমের সোনালি ফসল এখন পাহাড়িদের ঘরে ঘরে আলো ছড়াচ্ছে। আর এ ফসল তোলার আনন্দে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবে মেতে উঠেছে জুমচাষীরা।
বাংলাদেশে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এ তিন পার্বত্য জেলাতেই একমাত্র জুমচাষ হয়ে থাকে। পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস জুম চাষ।
এ বছর অনুকূল আবহাওয়ার বদৌলতে ধানসহ জুমের বাম্পার ফলন জুমচাষীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জুমের পাকা ধান ছাড়াও, চিনার, ঢেঁড়শ, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, যব, বেগুন, মরিচ, কাকরোলসহ বিভিন্ন ফসল ঘরে উঠছে। জুমে মিশ্র প্রজাতির শস্য বীজ বপনের প্রায় পাঁচ মাস পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের পর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ফসল ঘরে তোলে চাষীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ৪ হাজার ৫০১ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুমচাষ হয়েছে। এরমধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলায় ৫৮৭ হেক্টর, রোয়াংছড়িতে ৩৩০ হেক্টর, রুমায় ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর, লামায় ১ হাজার ২১৭ হেক্টর, আলীকদমে ৯১৫ হেক্টর ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ৭১৫ হেক্টর জমিতে জুমচাষ করা হয়। এতে প্রায় ৭ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া গেছে।
জুম চাষীরা জানান, ইঁদুরের উপদ্রব জুম চাষে অন্যতম বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। পাহাড়ে ইঁদুরের উপদ্রবে গত কয়েক বছর ধরে জুমের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি তারা। এতে অভাব-অনটনে কেটেছে বিগত কয়েকটি বছর। তবে এ মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান থাকায় জুমে প্রচুর ফলন হয়েছে। ইঁদুরের উৎপাতও কমেছে অনেকাংশে। তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস জুমচাষীদের মনে।
এদিকে চলতি মৌসুমে পাকা ফসল ঘরে তোলার খুশিতে মেতে উঠেছে আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা। ফসল ঘরে তোলার খুশিতে দলবেধে গাইছে ‘হিল্লো মিলেবো জুমত যায়দে, যাদে যাদে পধত্তুন পিচ্ছি ফিরি চায়, শর্ষে ফুলুন দেগিনে বুক্কো তার জুড়ায়...। ’ এ গানের বাংলা অর্থ হল-‘পাহাড়ি মেয়েটি জুমে যায়, যেতে যেতে পথ থেকে পিছে ফিরে তাকায়, শর্ষের ফুল দেখে বুক তার জুড়িয়ে যায়...। ’
পুরো মৌসুমের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে পাহাড়িরা যখন জুমের ফসল ঘরে তুলতে শুরু করে, তখন মনের আনন্দে জুম ঘরে তরুণ-তরুণীদের কন্ঠে শোনা যায় এ গান।
অন্যদিকে, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় আদিবাসী জুম চাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কাটার পর ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে পাহাড় জুম চাষের উপযোগি করে তোলে। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পাহাড়ে ঢালে গর্ত খুঁড়ে ধান, তুলা, তিল, কাউন, ভুট্টা, ফুটি, চীনার, যব ইত্যাদি ফসলের বীজ বপন করে।
এ ফসল পেতে অপেক্ষা করতে হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস পর্যন্ত। প্রথম দিকে মারফা, মরিচ, চিনার, ভুট্টা তোলা হয়। এরপর ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্তিক মাসে পাকতে শুরু করে ধান। শেষের দিকে তুলা, তিল, যব ঘরে তোলা হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের জুমচাষী ক্রামাচিং বাংলানিউজকে জানান, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার তার জুমের ফসল অনেক ভালো হয়েছে। আশা করছেন এবার জুম থেকে প্রায় ৩০ মণ ধান ঘরে তুলতে পারবেন। তবে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে আরো ভালো ফসল ফলানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বান্দরবান সদরের গেৎসমানি পাড়ার জুমচাষি ত্রিদিব চাকমা, থোয়াই হ্লা খয়, প্রগতি তঞ্চঙ্গ্যাসহ কয়েকজন জুমচাষী জানান, এবার জেলার রুমা, থানছি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবান সদর উপজেলার সাতকমল পাড়া, ডলুপাড়া, ফারুক পাড়া, শ্যারণ পাড়া, হাতিভাঙা পাড়া, গেজমানি পাড়ায় জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভবিষ্যতে জুমের ফলন আরো বেশি পেতে কৃষি বিভাগের সহযেগিতা চেয়েছেন তারা।
বান্দরবানের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বাংলানিউজকে জানান, কৃষি বিভাগ সবসময় কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। তবে এখনো আদি পদ্ধতিতে জুম চাষ পাহাড়ে স্থায়ী ক্ষতির কারণ হিসেবে দাড়িয়েছে। এতে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে পাহাড়ি জমির উবর্বরতা এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে ফলন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৪