ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

‘চল্লিশ দিন বয়সে বাপ মরছে’

ঊর্মি মাহবুব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৪
‘চল্লিশ দিন বয়সে বাপ মরছে’ ছবি: দেলোয়ার হোসেন বাদল /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘চল্লিশ দিন বয়সে বাপ মরছে। তারপর থেইকা লাত্থি-গুতা খাইয়া বড় হইতাছি।

’ কথাগুলো কিশোর ফয়সালের। গত ছয় বছর যাবত কখনো রাস্তায়, কখনো পার্কেই রাত কাটে তার। কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো জীবনটা ভিন্নরকম হতো।

ফয়সালের বাবা ফেরদৌস ছিলেন ময়মনসিংহের স্কুল শিক্ষক। স্বপ্ন ছিলো ছেলে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। এসব কথা মা রেজিয়া বেগমের মুখেই শ‍ুনেছে ফয়সাল।

স্বামীর মৃত্যুর পর দেবর-ভাসুররা বাড়ি থেকে বের করে দেয় রেজিয়া বেগমকে। দরিদ্র্য পরিবারের মেয়ে রেজিয়া আশ্রয় নেয় সিলেট উপশহরে বাবার বাড়িতে। বছর না ঘুরতেই রেজিয়ার বাবা তাকে আবার বিয়ে দেন রাজমিস্ত্রী হাবিবের সঙ্গে। সব মেনে নিলেও স্ত্রীর আগের স্বামীর ছেলে ফয়সালকে মেনে নিতে পারেননি দ্বিতীয় স্বামী হাবিব। এ কারণে হাবিব ও তার মায়ের ওপর চলতো সৎ বাবার নির্মম অত্যাচার। এক পর্যায়ে নানা বাড়িতে ছেলেকে রেখে আসতে বাধ্য হন রেজিয়া।

অনাদরে অবহেলায় পাঁচ বছর বয়সে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় ফয়সাল। কখনো চায়ের দোকানে, কখনো ফুটপাতে কাজ করতে থাকে ফয়সাল। পাশাপাশি ইউসেফ-এর স্কুলে যাতায়াত শুরু। মা রেজিয়া গোপনে ছেলেকে অর্থনৈতিক সাহায্য করতে থাকেন।

ক্লাস নাইনে ওঠার পর ছেলেকে গোপনে টাকা দেওয়ার কথা জেনে যান সৎ বাবা। মায়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সইতে না পেরে, সিলেট ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় কিশোর ফয়সাল। পার্কে না খেয়েই কাটে চারদিন। তারপর রমনা পার্কের বোতল কুড়ানোর ছেলেদের সঙ্গে যোগ দেয়।

এরপর থেকে গত তিন বছর ধরে রাস্তা থেকে বোতল কুড়িয়ে তা বিক্রি করে, কখনোবা পানির বোতল ফেরি করে চলছে তার। এভাবে কখনো কখনো দিনে ৩/৪ শ’ টাকা আয় হয় ফয়সালের।

প্রতি মাসে কিছু টাকা জমিয়ে মাকে পাঠায় বিকাশ করে। ফয়সাল বলে, মায় আমার জন্য অনেক মাইর খাইছে। এহন মার জন্য গোপনে ট্যাকা দেই, ফোন করি।

কিন্তু মাকে সরাসরি খুব কমই দেখতে পায় ফয়সাল। রোজার ঈদের আগে গোপনে এক নজর মাকে দেখতে সিলেটে গিয়েছিলো ফয়সাল।

এ কথা জানাতে ফয়সাল বলে, আমার এহনকার বাপে আমারে দেখতে পারে না। মায় আমার সাথে দেখা করছে শুনলেই মারব। আমি গোপনে গেছিলাম রোজার ঈদের আগে। ওইহানে গিয়া রিকশা চালাইছি, গ্যারেজে থাকছি। এই ফাঁকে মাইরে লুকায় লুকায় দেহি। মায়ও আমারে দেহে।

কথা বলতে বলতেই চোখ ভিজে যায় ফয়সালের। জীবনে কী হতে চায় জানতে চাইলে সোজাসাপ্টা জবাব, আমার মায়রে আমার কাছে রাখতে চাই। হেইল্লাইগা ব্যবসা কইরা ট্যাকা জমাইতে চাই। হের পরে বাসা ভাড়া কইরা মায়রে নিয়া আসুম। আমার মা-ই, আমার সব।

শত শত ফয়সাল এভাবেই জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বড় হয়ে উঠছে আমাদের সমাজে। হয়তো সমাজের প্রতি বুকের ভেতর কোথাও তীব্র ঘৃণা লালন করছে তারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।