প্রতিটি ছবিরই তিনটি করে গল্প। কোনওটির তারও বেশি।
আর ছবির কারিগর কাকলী প্রধান শোনাচ্ছিলেন একেকটি ছবির পেছনের গল্প। এই গল্প বাস্তব, আর একই সাথে প্রতিটি ছবির মানুষগুলোর জীবনের বাস্তবতা।
কাকলীর ক্যামেরা কথা বলে। যারা কাকলী প্রধানের ছবির সঙ্গে পরিচিত তাদের কাছে কথাটি পুরোনো। কিন্তু যারা নতুন প্রজন্মের, তাদের জন্য অনেকটা তাদেরই প্রজন্মের, কিংবা কিছুটা আগের প্রজন্মের এই ক্যামেরা কর্মী তার কাজগুলো উপস্থাপন করেছেন ‘না’ শিরোনামে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে এর স্থান হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণও দারুণভাবে জানা কাকলী প্রধানের।
এরা নতুন প্রজন্মের। এদের কাছে অনেক কিছুই অজানা। তাই অজানা গাঁও গেরামের কিছু সত্য তাদের সামনে রেখে বলা- দেখো দেশে কিই না অন্যায় হচ্ছে! আরেক কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে বলা যেতে পারে দেশের প্রতিটি গ্রামের ছেলে কিংবা মেয়েটি পড়ার সুযোগ পায়। গ্রাম-শহরের মিলনমেলা এই ক্যাম্পাসেই। ফলে গ্রামের ছেলেটি এখানেই যেনো দেখতে পায় তার নিজের গ্রাম, কিংবা ইউনিয়নে কি অন্যায়টিই না হচ্ছে।
অন্যায়ই প্রাধান্য পেয়েছে কাকলি প্রধানের এবারের প্রদর্শনীতে। সে অন্যায় ভূমি সংক্রান্ত। দেশের প্রতিটি পরতে পরতে নিজ ভূমি থেকে বঞ্চিত নারীদের ছবি, নারীদের সংগ্রামের ছবি, এর মাঝেও নারী বাধভাঙ্গা, কিংবা মুচকি হাসির ছবি, নারীর কান্নার ছবি সব স্থান পেয়েছে।
“আমি ধর্ষিতার ছবি তুলে তাই স্থান দিয়েছি এই প্রদর্শনীতে,” বললেন একজন সাহসী কাকলী। জানি ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ রীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু ধর্ষিতা নিজেই যখন চাইছেন তার ছবিটি প্রকাশিত হোক, তখন বাধা থাকতে পারেনা।
“ওরা আমারে আমার নিজের জমিতে ফেলে ধর্ষণ করেছে। জমিও নিছে, সম্ভ্রমও নিছে। আমার আর হারাবার কিই বাকি আছে, দেন ছবি প্রকাশ করে,” ধর্ষিতাকে উদ্ধৃত করছিলেন কাকলী।
কথাগুলো বলতে বলতে কাঁপছিলেন তিনি। তার কণ্ঠ যেনো দৃঢ় হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এইসব বঞ্চিত নিপীঁড়িত, ধর্ষিত নারীরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যানভাস সাজিয়ে বলছেন, দেখো আমরা কতটাই ধর্ষণ, বঞ্চনা আর নিপীঁড়নের শিকার। আর তার সবটাই ভূমিকে কেন্দ্র করে। ওরা আমাদের থেকে আমাদেরই জমিন কেড়ে নিতে চায়।
‘না’ কেনো? সে প্রশ্নেরও একাধিক উত্তর কাকলীর। ‘না’ এই জন্য যে এরা কথায় কথায় ‘না’ এর শিকার। ‘না’ এই জন্য যে ওদের তোমরা ‘না’ করো না। ‘না’ এই জন্যও যে, ‘নাহ!’ আর নয়, এবার প্রতিবাদ।
কাকলীর ছবিতে দুই কিশোরী হাসছে। কুমড়োফুলে চুল সাজিয়ে। ক্যাপসানে প্রশ্ন- ‘বলুনতো আমাদের মধ্যে কে হিন্দু কে মুসলমান?’ কি কঠিন প্রশ্ন! কে দেবে তার উত্তর। কিন্তু কাকলির ছবিতেই রয়েছে সে উত্তর।
কিশোরীটির পরিবারের ভূমি কেড়ে নেওয়া হযেছে। এবার চলে যাওয়ার পালা। ক্যামেরায় ফেড আউট হয়ে যাচ্ছে একজন। তার মাধ্যমেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কার জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কাকে চলে যেতে হবে শিগগরই।
কোনো কোনো ছবিতে এত কষ্টেও হাসি। কেনো? কাকলি বললেন, ওরা না কষ্টেও হাসে। হয়তো ওই হাসতে পারার ক্ষমতাটুকুই এখন বেঁচে থাকার শক্তি। আর কান্না ওদের মনে ও বুকে চেপে থাকা কষ্টের ভার কমায়।
ছবিগুলোর প্রতিটিই সত্য গল্প। খবর শুনে নিজে ছুটে গিয়ে, প্রয়োজনে দিনরাত থেকে গল্প উপলব্দি করে তবেই ছবিগুলো তোলা। ছবির গল্প যেমন সত্য, তেমনি সত্য এর ছবি তোলার কাহিনী। আর সবচেয়ে বড় সত্য, ছবির জন্য কাকলী প্রধানের একাগ্রতা।
নিজের ঝুঁকি নেওয়ার কথাগুলোও জানালেন। কোথায় কোন ছবি তুলতে গিয়ে কতটুকু ঝুঁকি নিয়েছেন? তার উত্তর একটাই- নিজের ঝুঁকি নিয়ে ভাবি নি। তবে আমার কাজের কারণে নিঁপীড়িত মানুষগুলো যেনো আরও ঝুঁকিতে না পড়েন, সেটা নিশ্চিত করেছি।
একটি ভালো ছবির জন্য বিষয়বস্তু যাতে হারিয়ে না যায় সে চেষ্টাই ছিলো, বিষয়বস্তুর কারণে ছবির ভালোত্ব হারিয়েছি, বললেন একজন আত্মনিয়োজিত এই ফটো সাংবাদিক।
বলেন, পেশার কারণে অনেক ছবিই তুলি। কিন্তু নেশায় মিশে থাকা ছবির কাজে যেনো পেশার অংক না চলে আসে সে চেষ্টা অবশ্যই থাকে।
প্রেরণা হিসেবে বাবা প্রয়াত গোলাম মোস্তফা প্রধানকেই দেখেন। দেশের জন্য লড়াই সংগ্রামে অংশ নেওয়া, একসময় ছাত্র ইউনিয়নে সক্রিয় তার বাবা ছবি তুলতেন, ভালো ছবি। আর সেটাই অনুপ্রেরণা, বললেন কাকলী প্রধান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বুধবার শুরু হয়েছে সেসব ছবির প্রদর্শণী, চলবে শুক্রবার পর্যন্ত।
বাংলাদেশ সময় ১২০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪