ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

অভ্যাসগুলো আপনাকেও করে তুলবে সৃজনশীল

রাজিউল হাসান, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
অভ্যাসগুলো আপনাকেও করে তুলবে সৃজনশীল

প্রায়ই কোনো না কোনো আড্ডায় কাউকে না কাউকে আফসোস করতে শোনা যায়—“ইশ! আমি যদি কবি হতাম, কিংবা যদি চিত্রকর, অথবা যদি গাইতে পারতাম গান!” বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আফসোসেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় মনের এমন আকাঙ্ক্ষাগুলো। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু অভ্যাস আর চিন্তা-ভাবনাই একজন সাধারণ মানুষকে সৃজনশীল করে তুলতে পারে।

প্রয়োজন শুধু বিষয়গুলোর নিয়মিত চর্চা।

সম্প্রতি ডেনিয়েলে ক্রাইসা একটি বই লিখেছেন, নাম ‘দ্য জেলাস কিউরেটর’। এর একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘দ্য ব্লক’। এ অধ্যায়ে তিনি অর্ধশত পেশাদার ও অপেশাদার, প্রশিক্ষত ও স্ব-প্রশিক্ষিত সৃজনশীল মানুষের সাক্ষাৎকার যুক্ত করেছেন, যাতে কিভাবে একজন মানুষ তার মানসিক বাঁধা বা ব্লক অতিক্রম করে হয়ে উঠতে পারেন সৃষ্টিশীল—তার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে।

অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এই ‘সৃজনশীল বাঁধা’ বা ‘ক্রিয়েটিভ ব্লক’ই তার আফসোসের বড় কারণ। এ ব্লকগুলো ও সেগুলো থেকে উত্তরণের কিছু উপায় নিয়েই বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য এবারের আয়োজন।

যা হবার হবে
মনে অনেক কথা জমা আছে, কল্পনায় ভেসে ওঠে হাজারও দৃশ্য, ইচ্ছে হয় কাগজে বা ক্যানভাসে জমে থাকা কথাগুলো বা ভেসে ওঠা দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু অনেকেই পারেন না। কেউ কেউ ভাষার অভাব হবে কিংবা হাস্যকর কিছু একটা হবে ভেবে শুরুটাও করেন না। কেউ শুরু করলেও খানিক এগিয়েই থেমে যান। কাউকে গাইতে বলা হলে সুর-তাল-লয় ঠিক হবে না ভেবে সঙ্কোচে পিছিয়ে যান, অথচ গাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়ে যায় মনে।

এ ধরনের সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে ব্রুকলিনের ইলাস্ট্রেটর ও লেটারিং মাস্টার ম্যারি কেট ম্যাকডেভিট পরামর্শ দিয়েছেন, যা হবার হবে, এগিয়ে যেতে হবে।

সৃষ্টিকর্ম ভালো বা যথাযথ হচ্ছে না ভেবে অনেকেই থেমে যান। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ভালো না হলেই পৃথিবীতে প্রলয় নেমে আসবে না। কাজেই এগিয়ে যেতে দোষ কোথায়, প্রশ্ন ম্যারি কেট ম্যাকডেভিটের।

আনন্দ করতে হবে
অনেক সৃজনশীল মানুষকেই দেখা যায়, নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছেন কিংবা ততটা সামাজিক নন। সাধারণের ধারণা, তারা হয়ত ঘরের কোণে বসে নিজের সৃষ্টির আকার দেন। আর এ ধারণা থেকেই কেউ কেউ সৃজনশীল হয়ে ওঠার চেষ্টাকালে নিজেকে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেন। মস্তিষ্কের ওপর অযথাই চাপ প্রয়োগ করেন।

এমন মানুষের জন্য নিউ হ্যাম্পশায়ারের বাসিন্দা শিল্পী ও শিক্ষক অ্যারিস মুর বলেছেন, ব্লক থেকে নিজেকে উদ্ধারে আমি আনন্দকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেই।

এর অর্থ নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হবে। আনন্দ করতে হবে। জীবনকে উপলব্ধি করতে হবে। তবেই তৈরি হবে মনের মতো সৃষ্টি।

সমালোচনাকারীকে ভয় পেলে চলবে না
কেউ হয়ত সমালোচনা করবে, এমন আশঙ্কায় অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কবিতা লেখেন না, ছবি আঁকেন না কিংবা গাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। আর এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ঘনিষ্ঠজনদেরই সমালোচনাকারীর ভূমিকায় দেখা যায়।

এ সমস্যাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হবে বলে মত যুক্তরাজ্যের ইলাস্ট্রেটর অ্যান্থনি জিনোনসের। তিনি বলেছেন, এই সমালোচনাকারীরা হয়ত বারবার দেখা করবে, বার্তা পাঠাবে। এদের মুখোমুখি হতে না চাইলেও আপনাকে হতে হবে।

এমন পরিস্থিতিতে তাদের সমালোচনার জবাব হিসেবে দমে না গিয়ে সামনে বাড়তে হবে। একটা সময় তার কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নেওয়া যাবেই বলে মনে করেন অ্যান্থনি।

ভেতরের শত্রুকে দমন
ক্ষেত্র বিশেষে নিজের ভেতর থাকা মানুষটাই সৃষ্টির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। হয়ত কাজ চলাকালীনই সে বলে বসতে পারে, হচ্ছে না কিছু। আর এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষই হাল ছেড়ে দেন।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় পোর্টল্যান্ড-ওরেগনের চিত্রশিল্পী লিসা গোলাইটলি বলেছেন, নিজের ভেতরে মানুষটা কাজের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কখনোই হাল ছেড়ে দেবেন না। কাজটা চালিয়ে যান। একটা কিছু তো হবেই।

তাই বলে সব আত্মনিগ্রহই খারাপ নয়
তাই বলে মনের সব বাধাদানই খারাপ নয়। কিছু কিছু সমালোচনা সৃষ্টিকর্মকে আরো প্রশংসনীয় করে তুলতে পারে।

নিউইয়র্কের চিত্রশিল্পী ট্রে স্পিগল বলেছেন, আপনাকে সূক্ষ্ম প্যারামিটার তৈরি করে নিতে হবে। এবং এসবের ভেতরেই আপনার নিজেকে মুক্তভাবে বিচরণের যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে।

নিজের মন্ত্রকে খুঁজে বের করুন
প্রতিটা সৃজনশীল মানুষেরই ব্যক্তিগত একটা মন্ত্র বা স্লোগান থাকা মন্দ নয়। সে মন্ত্র স্বরচিতও হতে পারে, আবার অন্য কারোও হতে পারে। আসলে নিজেকে উৎসাহ যোগাতেই এ ধরনের মন্ত্র থাকা উচিত।

জার্মান চিত্রগ্রাহক ম্যাথিয়াস হেইদেরিচ বলেছেন, চার্লস হর্টন কুলির একটি বাক্য আমি নিজের মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি। প্রায়ই তা আওড়াতে থাকি। আর তা হলো—একজন শিল্পী বিফল হতে পারে না।

নিজের সময় নির্ধারণ
প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব একটা সময়ানুবর্তিতা থাকে। হয়ত কোনো শিল্পীকে দিনভর ঘুমিয়ে সারারাত জাগতে দেখা যায়, আবার কাউকে ভোররাতে উঠে যেতে। এটা আসলে প্রতিটা সৃজনশীল মানুষেরই নিজস্ব সময়ানুবর্তিতা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার ধরন।

এ ব্যাপারে বোস্টনের চিত্রশিল্পী লিয়াহ গিবার্সন বলেছেন, আমি প্রতিদিন এমন সময় জেগে উঠি, যখন আমার বাড়ির বাকি সদস্যরা ঘুমের জগতে বিচরণ করতে থাকে।

নিজেকে জ্বালানি সরবরাহ
খাবার অর্থে এ জ্বালানি শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। এ জ্বালানি আসলে মনের। সৃজনশীল হয়ে উঠতে চাইলেই যে একজনকে কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তা কিন্তু নয়। মনকে এমন কিছু উপভোগের সুযোগ দিতে হবে, যার ফলে সে চনমনে হয়ে ওঠে। হতে পারে তা গান শোনার মাধ্যমে, কিংবা চলচ্চিত্র দেখার অথবা ঘোরাফেরা।

কেনসাসের শিল্পী পেরেগ্রিন হনিগ বলেছেন, মানসিক অবসাদ থেকে সেরে উঠতে অন্তরঙ্গতা, পানীয় আর সঙ্গীত খুব ভালো জ্বালানি।

নিজের প্রতি নম্র হতে হবে
অনেকেই নিজের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে কিংবা অন্যের সমালোচনার মুখে নিজের প্রতি কঠোর হয়ে ওঠেন। মুশকিশ হচ্ছে, এমনটা করলে কখনোই ব্লক থেকে মুক্তি মিলবে না।

টরন্টোর বাসিন্দা সিরামিক আর্টিস্ট ওয়েন্ডি ওয়ালগেট বলেছেন, আমি কোনো প্রতিভাবান নই এবং আমার কাজগুলো আসলে আমার অদ্ভুত মানসিকতার প্রতিফলন। এক্ষেত্রে অন্যে কী ভাবছে, তা চিন্তা করা আপনার কখনোই উচিত হবে না।

দ্বিধায় সহায়তা চাওয়া
সৃজনশীল কাজে দ্বিধা একটি বড় বাধা। এর কারণে অনেক ক্ষেত্রেই থেমে যেতে হয়। আবার দ্বিধা কাটাতে অন্যের সাহায্য নিতেও সঙ্কোচবোধ করেন অনেকে। এ বিষয়ে মিলওয়াউকির শিল্পী ক্যাসান্দ্রা স্মিথ বলেছেন, কাজের ক্ষেত্রে সঠিক পথে আছি কি না, সে নিয়ে দ্বিধায় ভুগলে আমি তাৎক্ষণিক কাছের মানুষের কাছে সহায়তা চাই।

জাগতিক সকল বিষয় থেকে উৎসাহ খুঁজে নেওয়া
টেক্সাসের ডিজাইনার অ্যালিসন ফক্স বলেছেন, জাগতিক বিষয় থেকে আমি উৎসাহ খুঁজে নেই। সেটা হতে পারে কোনো হার্ডওয়ার স্টোর কিংবা ভবন বা শূন্য কোনো ঘর থেকে, কিংবা হতে পারে মানুষের বাকবিতণ্ডা, আলাপচারিতা থেকেও।

মন পরিষ্কার রাখতে হবে
সৃজনশীল কাজে অবশ্যই পরিষ্কার মন জরুরি। কলুষমুক্ত মনের পাশাপাশি ভারমুক্ত মনটাও এক্ষেত্রে প্রয়োজন। কেউ কেউ হয়ত বলতে চাইবেন, মানুষ হয়ে মনের ভার রাখা চলবে না, এ কেমন কথা! আসলে এ ভার বলতে বোঝানো হয়েছে, কাজের স্থান পরিষ্কার রাখার কথা। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কাজ করার আনন্দটাই অন্যরকম। এক্ষেত্রে মনের সৃজনশীলতা ফুটে ওঠে খুব সহজেই।

ব্রুকলিনের ডিজাইনার জুলিয়া রোথম্যান বলেছেন, আমার স্টুডিও সবসময় সুসজ্জিত থাকলেও নতুন ডেস্কে বসে কাজ শুরু করলে আমি নতুন প্রেরণা খুঁজে পাই।

ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে বিচার
সুইডেনের ইলাস্ট্রেটর ক্যামিলা অ্যাংম্যান বলেছেন, অনেক সময়ই কোনটা সঠিক নয়, কোনটা পরিবর্তন করা জরুরি, তা খুঁজে বের করা কঠিন। এমন ক্ষেত্রে আমি আমার কাজকে আয়নার সামনে দাঁড় করাই। ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আমি তা বিচারের চেষ্টা করি।

আবেগকে প্রশ্রয় দিতে হবে
অনেকেই অতিমাত্রায় বাস্তববাদী। আবেগকে প্রশ্রয় দিতে চান না। কিন্তু সৃজনশীল কাজে আবেগ অতি জরুরি। এ ব্যাপারে টেনেসির বাসিন্দা পেপার কলেজ শিল্পী হোলি চ্যাস্টাইন বলেছেন, যখন আবেগের অভাব বোধ করি, তখন কাজও থেমে যায় আমার।

ব্যর্থতা সাফল্যের পূর্বধাপ
একবার ব্যর্থ হলেও থেমে যাওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, সাফল্যের ভিত্তি শক্ত করে ব্যর্থতা। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মেইনের শিল্পী শ্যানন র‍্যাঙ্কিন বলেছেন, আমার কাজের মধ্যে আমি সবসময়ই ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ আমি জানি, ব্যর্থতা কখনো কখনো সাফল্য এনে দেয়।

কাজের প্রক্রিয়া পরিবর্তনে ভীত হলে চলবে না
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডেলিডের বাসিন্দা শিল্পী দেইদ্রে বাট-হুসাইম বলেছেন, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করায় আমি কোনো দোষের কিছু দেখি না। উল্টো এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কাজকে কখনো কখনো আরো সুন্দর করে তোলে।

কখনো কাজ অসমাপ্তও থেকে যেতে পারে
কখনো কখনো কাজ অসমাপ্তও থেকে যেতে পারে। শিল্পকর্ম যে সবসময়ই শেষ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ব্রুকলিনের শিল্পী এমিলি বার্লেত্তা বলেছেন, আমি অনেক কাজই শেষ করতে পারিনি এবং এই অসমাপ্ত থাকাটাই যেন ওই কাজগুলোর সৌন্দর্য।

ধ্বংস থেকেও আসতে পারে সৃষ্টি
একটা কিছু সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, কিন্তু তা মন মতো হচ্ছে না। আবার ছুঁড়ে ফেলে দিতেও ইচ্ছে করছে না। এমন ক্ষেত্রে কাজ থেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্টারিওর শিল্পী জেসিকা বেল বলেছেন, যখন আমার ক্ষেত্রে এমনটা হয়, সঙ্গে সঙ্গে আমি কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি। আর আমার মনে হয়, এ কাজটা করার কারণেই পরে মনের মতো করে কাজটা শেষ করতে পারি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৫
আরএইচ/টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।