ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বিষ দরিয়ায় নৌকা ভ্রমণ (ভিডিও)

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
বিষ দরিয়ায় নৌকা ভ্রমণ (ভিডিও) ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নদীর তীরেই গড়ে ওঠে সভ্যতা। জীবনের শুরু যেমন পানি থেকে সভ্যতার শুরু তেমনি নদী থেকে।

আজকের শহর ও সভ্যতা নদী থেকে হয়তো অনেক দূরে সরে গেছে। কিন্তু তার শুরুটা ছিল নদীকে ঘিরেই। পৃথিবীর সব আদি শহর ও সভ্যতার সূচনা নদীর তীরে।

ইতিহাসে পাই, খ্রিস্টিয় ৭ম শতক থেকে ঢাকায় জনবসতির শুরু। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ঢাকা বিভিন্ন শাসকের অধীনে ছিল। কখনো রাজত্ব করেছে বৌদ্ধ রাজারা, কখনো সেন, তুর্কি ও আফগানরা। মুঘলরা ঢাকায় আসে ১৬০৮ সালে।   এর পর ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনের পথ ধরে আরো ২২৪ বছর।

তেরশ’ বছরের পুরনো সেই ঢাকা আজ আর নেই। পুরনোকে পেছনে ফেলে গড়ে উঠেছে এক নতুন ঢাকা। আজকের ঢাকা আরো প্রসারিত ও বিস্তৃত।  

বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন ঢাকা। আজকের যে ঢাকার শুরুত্ব তাও বুড়িগঙ্গার তীরে, বড়িগঙ্গার জন্য। বুড়িগঙ্গার জন্যই ঢাকার এতো গুরুত্ব। ঢাকার জীবনে বুড়িগঙ্গা আজও অপরিহার্য।   

ঢাকা আজ মেগাসিটি। এই মেগাসিটিকে গড়তে গিয়ে বুড়িগঙ্গাকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি। বুড়িগঙ্গা আজ পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগারে। এ নদী এখন মেগাসিটির মলমূত্র, আবর্জনা ও রাসায়নিক বর্জের আধার।

এক সময় এই নদীতে মাঝিরা সাম্পান ভাসাতো, জেলেরা জাল ফেলতো। স্বচ্ছ ও খরস্রোতা জলের আসা যাওয়া ছিল বুড়িগঙ্গায়। সেই নদী আজ কোথায়? বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ জলের ধারা আজ শুধুই অতীত।

কোটি মানুষের বিষাক্ত বর্জ্য বুকে ধারণ করে বয়ে চলেছে এই নদী। দুই ধারে তার বেপরোয়া নগরায়নের ছাপ।   

বুড়িগঙ্গার যে স্বচ্ছ জল ছিল ঢাকার প্রাণ, আজ সে পানির সংস্পর্শেও আশাও যেন বিপদের কারণ। এ নদীর প্রতিটি ফোটার সাথে রয়েছে ঢাকার অস্তিত্বের সম্পর্ক। ঢাকা কেন্দ্রিকই যেহেতু বাংলাদেশের বেড়ে ওঠা। তাই পুরো দেশেরই ঋণ রয়েছে বুড়িগঙ্গার কাছে। আদি বাংলাদেশের শুরু ঢাকা থেকে আর ঢাকার যাত্রা বুড়িগঙ্গা থেকে।

বুড়িগঙ্গার পানি আজ বিষ। বুড়িগঙ্গাকে বিষ পান করিয়ে, বিষে ভাসিয়ে ইতিহাসের সেই ঋণ শোধ করছি আমরা। বুড়িগঙ্গা যেন আজ এক বিষপ্রবাহ। ঢাকাকে বিষমুক্ত করে নিজে মৃত্যু সুধা পান করছে।

যে বুড়িগঙ্গার রূপসুধা পানে মুগ্ধ হয়েছিল বৌদ্ধ, সেন, পাল, মুঘল ও ব্রিটিশরা। আজ কোথায় হারিয়ে গেল সেই হাজার বছরের রূপ?  হাজার বছর ধরে ঢাকার হৃদপিণ্ডে স্পন্দন জাগিয়েছিল যার রক্তপ্রবাহ আজ শুষ্ক কেন তার নিজেরই হৃদয়? বুড়িগঙ্গার বুকে এক সকালে চলতে গিয়ে ভাবছিলাম সেই পুরনো নদীকে। হৃদয়ে ইতিহাসের বুড়িগঙ্গা আর দৃষ্টিতে এক মরা নদীকে নিয়ে এগিয়ে চলছিলাম ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে। নাকে ভেসে আসছিল বুড়িগঙ্গার রাসায়নিক বিষবাষ্প। এই বুঝি বুড়িগঙ্গা!

ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য জেলায় জলপথে যাতায়াতের এটিই একমাত্র নদী। দক্ষিণের সাথে দেশের যোগাযোগেরও প্রধান মাধ্যম এ বুড়িগঙ্গা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখান থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোর উদ্দেশে ছেড়ে যায় অসংখ্য লঞ্চ ও জাহাজ। আবার প্রতিদিন সকালে এসে পৌঁছায় তারা। এসব লঞ্চে সৃষ্ট যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা নদীতেই ফেলা হয়। এছাড়া পোড়া তেল-মবিল বা জ্বালানি ও টনকে টন মলমূত্র মিশে যাচ্ছে নদীতে। এ নদীর গভীরে জমে গেছে কয়েক ফুট আবর্জনার স্তুপ। লক্ষ-কোটি টন আবর্জনার স্তুপ পাকস্থলিতে ধারণ করে বয়ে চলেছে মৃত নদী বুড়িগঙ্গা। নদী না বলে একে একটি বিষাধার বলাই ভালো।  

লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো রকমের সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর লঞ্চ পরিষ্কার করতে গিয়ে যাবতীয় ময়লা আবর্জনা নদীতেই ফেলা হয়। অথচ একটু সচেতন হলেই এ ময়লা-আবর্জনাগুলো নদীর বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা যায়। এতে করে বেঁচে যাবে একটি নদী। বাঁচাবে একটি শহরের প্রাণ। এদিকে সাধারণ যাত্রীদের মাঝেও নেই কোনো রকম সচেতনতা। ফলে, বুড়িগঙ্গা তার নিয়তি নির্ধারিত পথেই চলছে। মৃত্যুই যেন বুড়িগঙ্গার পরিণতি।  

শিল্পায়ন একটি শহর তথা একটি দেশের জন্য আর্শিবাদ। কিন্তু বুড়িগঙ্গার জন্য তা যেন অভিশাপ। নদীর দুই তীর ঘিরে ক্রমবর্ধমান ও বেপরোয়া শিল্পায়নের জন্য বুড়িগঙ্গা আজ যেন একটি মৃত সরীসৃপ। সরু হতে হতে এখন তা একটি অদৃশ্য সুতোর মতো ঢাকায় প্রবেশ করেছে। নিয়ম-কানুন মেনে কেউ কেউ মিল-কারখানা করছে বটে। কিন্তু বেশির ভাগই এসবের ধার ধারছেনা। পৃথিবীর বেশির ভাগ রাজধানী বা শহরই কোনো না কোনো নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার মতো পরিণতি বরণ করে নিতে হয়নি কোনো নদীকে।  

নদীর দুই তীরে ব্যবহৃত পলিথিনের নিরাপদ গন্তব্য এই নদী। সেই সাথে অন্যান্য আবর্জনাতো আছেই। বুড়িগঙ্গা শুধু সদর ঘাটের জন্যই বিখ্যাত না। দেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্রও এটি। এর দুই তীরেই আছে দেশের বড় বড় সব আড়ৎ। ঢাকার কাচামালের অন্যতম বাণিজ্য ও সরবরাহ কেন্দ্র বুড়িগঙ্গার দুই তীর ঘেষে। শাক-সবজী ফল-মূলের আড়ৎ সব আছে বুড়িগঙ্গার তীরে। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার ব্যস্ততার শেষ নেই। সব কিছুকেই সচল রাখছে বুড়িগঙ্গা। কিন্তু নিজেই হারাচ্ছে গতি। হয়ে যাচ্ছে অচল।

এদিকে শহরের ট্যানারিবর্জ্য ও শিল্পকারখানার বর্জ্যতো আছেই। শহরের সব স্যুওরেজ লাইনের সংযোগ রয়েছে বুড়িগঙ্গার সাথে। এক কথায় ঢাকা যতো পরিষ্কার বুড়িগঙ্গা ততো দূষিত।  

ঢাকার মধ্য দিয়ে বহমান অন্যান্য নদীগুলোর চিত্রতো আরো ভয়াবহ। এগুলোকে আর নদী না বলাই ভালো। কোনো কালে এগুলো যে নদী ছিল তা দেখে বোঝার উপায় নেই। এগুলো এখন আবর্জনার ভাগার। ঢাকার সব দূষিত জল ও আবর্জনা এসব নদী বহন করে নিয়ে যায় বুড়িগঙ্গায়।

কোটি মানুষের পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সব বর্জ্য সেপটিক ট্যাঙ্কের মাধ্যমে মিশে যায় বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গার বায়ু সেবনও ঝুকিপূর্ণ। বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভাসিয়ে নির্মল বায়ু সেবন আজ অতীত।

ইতিহাসে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। এক সময় এ নদীর তীরে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা হতো। নদীর বুকের অনেক নৌকাতে নাকি ফানুস বাতিও জ্বলতো। বর্ষায় বুড়িগঙ্গার রূপ দেখে ঢাকাকে তুলনা করা হতো ভেনিসের সাথে।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে অভিযান কম হয়নি। মানব বন্ধন থেকে মামলা কোনো কিছুই বাদ যায়নি। ঢাক ঢোল পেটানো হয়েছে তার চেয়ে বেশি। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করেছে, সুশিলরাও কম যায়নি। কিন্তু বিষের মাত্রা তাতে কিছু কমেনি। নদীর দুই ধারে উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। কিন্তু শহরের বর্জ্যতো সব উধাও হয়ে যায়নি। তার ঠিকানাতো আজও বুড়িগঙ্গা। আরো কত শত আবর্জনা বুকে ধারণ করে বয়ে চলেছে ঢাকার প্রাণ প্রবাহ-বুড়িগঙ্গা। সদর ঘাট থেকে কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার এই দূষিত চিত্র দেখা যায়। এরপর ধীরে ধীরে জল কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে আসে। এভাবে চললে দুষিত বুড়িগঙ্গা আরো বিস্তৃত হবে এবং হচ্ছেও তাই। কিন্তু এভাবে আর কত দিন বইবে সে?
 
আমরা ফিরে পেতে চাই ইতিহাসের স্বচ্ছ জলের ধারা-বুড়িগঙ্গাকে। অভিশপ্ত বিষ দরিয়ার বুকে খুজেঁ পেতে চাই হারানো বুড়িগঙ্গাকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৬
ইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।